আওয়ামী লীগের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সাংগঠনিক সম্পাদক, সাত বারের সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের বিলাসবহুল বাসভবন এখন জনমানবশূন্য ভূতের বাড়িতে পরিণত হয়েছে। জামালপুরের মাদারগঞ্জ পৌরশহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বালিজুড়ী বাজারে অবস্থান ভিআইপি বাড়িটির। এক সময় বিলাসবহুল বাড়িটিতে ছিল নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। দিনে ও রাতে ছিল পাহারার ব্যবস্থা।
বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের শত শত নেতাকর্মীদের পদচারণায় সরগরম ছিল বাড়িটি টানা ৩৩ বছর। কিন্তু সেই বাড়িটিতে এখন সুনসান নীরবতা। বাড়িটিতে মাদকসেবী ও বখাটে ছেলেপেলে ছাড়া এখন কোনো লোকজন প্রবেশ করে না। নেই কোনো নিরাপত্তারক্ষীও। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শত শত মানুষ মির্জা আজমের বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। ভেতরে থাকা সব আসবাবপত্র, দরজা-জানালা লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। সুদৃশ্য বাড়ির ক্ষতবিক্ষত ভবনটি দেখলে মনে হবে কোনো ভূতুড়ে বাড়ি। মির্জা আজমের এক সময়কার বিলাসবহুল বাড়িটি এখন মাদকসেবী আর কিশোর গ্যাংয়ের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মির্জা আজমের জন্ম উপজেলার বালিজুড়ী ইউনিয়নের সুখনগরী গ্রামে। তার পিতা মির্জা আবুল কাশেম ছিলেন খাদ্য ব্যবসায়ী। বাবার ব্যবসার সুবাদে পৌর বালিজুড়ী বাজার এলাকাতেই মির্জা আজম ও তার পরিবার বসবাস শুরু করেন। মির্জা আজম ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জামালপুর-৩ আসন থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। এরপর ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে জামালপুর-৩ আসনে সংসদ সদস্য হন। তিনি সরকার ও বিরোধী দলীয় হুইপ, বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। এ ছাড়া তিনি জামালপুর জেলা যুবলীগের সভাপতি, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ৩৩ বছর দলীয় প্রভাব, ক্ষমতার অপব্যবহার ও সন্ত্রাসী বাহিনী ব্যবহার করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছে আওয়ামী লীগের এই প্রভাবশালী নেতা। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর মির্জা আজম ও তার আত্মীয়স্বজনরা আত্মগোপনে রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মাদারগঞ্জ পৌরশহরের বালিজুড়ী বাজার এলাকায় মির্জা আজমের আলিশান বাড়িটি এখন জনমানবশূন্য। গত বছরের ৫ আগস্ট মির্জা আজমের তিনতলা দুটি ভবনের প্রতিটি কক্ষের সব আসবাবপত্র লুট করে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। খুলে নিয়ে গেছে ভবন দুটির প্রায় প্রতিটি কক্ষের দরজা-জানালা। দরজা-জানালা খুলতে ভেঙে গেছে ভবনের দেয়াল। মেঝেতে পড়ে আছে ইটের খোয়া, কাচের টুকরা ও মাদক সেবনের বিভিন্ন উপকরণ। একসময় সুরক্ষিত বাড়িতে মাদকসেবন, লুটপাট, ভাঙচুর তো দূরের কথা ভেতরে প্রবেশ করতেই সাহস পায়নি কেউ।
স্থানীয় বাসিন্দা লুৎফর রহমান বলেন, মির্জা আজম অনেক টাকা ব্যয় করে বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। সরকার পতনের পর থেকে তারা বাড়িছাড়া। আগে এই বাড়িতে মধ্যরাত পর্যন্ত দলের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন মানুষের যাতায়াত ছিল। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, দলের নেতাকর্মী ও আত্মীয়স্বজন কেউই মির্জা আজমের বাড়ির ধারে-কাছে ভেড়েন না।
বালিজুড়ী নামাপাড়া এলাকার সোবাহান আলী বলেন, নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা মির্জা আজমের আলিশান বাসভবন এখন ভূতের বাড়িতে পরিণত হয়েছে। বাড়িটিতে সন্ধ্যা নামতেই মাদকসেবীরা আড্ডা জমায়।
উপজেলা যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মোখলেছুর রহমান মোখলেছ বলেন, মির্জা আজম মেলান্দহ-মাদারগঞ্জে ত্রাসের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যেতেই মির্জা আজমের ত্রাসের সাম্রাজ্য ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। মির্জা আজমের বাসভবনে ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে নির্যাতিত সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। নিকৃষ্টতম শাসনের অবসান ঘটায় সাধারণ মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে। যুবদলের এই নেতা আওয়ামী লীগের গডফাদার মির্জা আজম ও তার পরিবারের সদস্যদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা এবং মির্জা আজমকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন।