ভারত বাংলাদেশের নিরাপদ প্রতিবেশী নয়। তা সত্ত্বেও আমাদের তার পাশেই থাকতে হবে। কোনো দেশই তার প্রতিবেশীকে সরিয়ে দিতে পারে না। সহাবস্থানে বিশ্বাসী প্রতিবেশী যেকোনো দেশের জন্যই সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা সৌভাগ্যবান নই। বিভিন্নভাবে অন্যের দেশ দখল করে ভারত এখন বিশাল ভূখণ্ডের অধিকারী। ভারতের বর্তমান ভূখণ্ডের ৪৮ শতাংশই দখলকৃত। জবরদখলের মতো জঘন্য অপকর্মকে ভারত তার স্বাভাবিক কার্যক্রমের অংশ বলেই মনে করে। ভারতের এই আগ্রাসী মানসিকতা তার সব প্রতিবেশীর জন্যই বিপজ্জনক। প্রতিবেশী সব দেশেই ভারত তার অনুগত লোক তৈরি করেছে এবং তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। ভারত চায় না, বাংলাদেশ ভারত ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো দেশের সঙ্গে স্বাধীনভাবে সম্পর্ক রক্ষা করুক। পাকিস্তান-চীন তো দূরের কথা, এমনকি ভারতকে ডিঙিয়ে আমেরিকার সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলুক, তা ভারতে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। ভারতের এ ধরনের তৎপরতা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য শুধু অপমানজনকই নয়, আমাদের অস্তিত্বেরও প্রশ্ন।
ভারত মনে করে, দেশটির আশপাশের ক্ষুদ্র দেশগুলো স্বাভাবিকভাবে ভারতের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। অন্যথায় সেগুলো চক্রান্তের মাধ্যমে কিংবা জোরপূর্বক দখলে নিয়ে ভারতের অংশ করতে হবে। এ ধরনের একটি আগ্রাসী দেশের প্রতিবেশী হওয়ার বিপদটা বাংলাদেশের জনগণ প্রতিনিয়ত অনুভব করেন। পৃথিবীতে বহু বিশাল দেশের পাশেই ক্ষুদ্র দেশ রয়েছে। কিন্তু সেগুলো শত শত বছর ধরে নিজস্ব ক্ষুদ্র ভূখণ্ড, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে টিকে আছে। কারণ তাদের পাশে ভারতের মতো আগ্রাসী কোনো প্রতিবেশী নেই।
যেহেতু এ সমস্যা আমরা ভৌগোলিক তথা প্রাকৃতিকভাবেই পেয়েছি, তাই আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রস্তুতি থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে আশার খবর হলো, বাংলা ভূখণ্ডের মানুষ ঐতিহাসিকভাবেই বিদ্রোহী ও স্বাধীনচেতা। তারা কখনো বাইরের শক্তির কাছে মাথানত করেনি। লাখ লাখ মানুষের শাহাদাতের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, এদেশকে রক্ষা শক্তি-সামর্থ্য আমাদের আছে। আমরা কারো সঙ্গে যুদ্ধ চাই না। তবে কেউ যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে আমরা বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করব না।
আমরা তো ১৯৭১ সাল থেকেই ভারতের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ এবং বন্ধুত্বমূলক নীতিই গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু ভারত এক দিনের জন্যও আমাদের সঙ্গে তেমন আচরণ করেনি। ভারতের বন্ধুত্ব ছিল মুখে, কিন্তু বাস্তবে ভারত কখনোই বাংলাদেশের ভালো চায়নি। বন্ধুত্বের কথা বলে ভারত আমাদের বশ্যতা ও দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি সব আয়োজন সম্পন্ন করেছিল।
২০০৯ সালে মঈন-ফখরুদ্দীনকে দিয়ে ভারতনিয়ন্ত্রিত ও পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতীয় চর শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। তাকে ক্ষমতায় বসানোর পরপরই ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান শংকর রায় চৌধুরী প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন : বাংলাদেশকে আর কখনোই ভারতের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হতে দেওয়া হবে না। কিন্তু আমাদের বীর ছাত্র-জনতা জুলাই-আগস্টে অভাবনীয় বিপ্লব ঘটিয়েছে। ফলে দিল্লির দাসী হাসিনা তার প্রভুর কোলে আশ্রয় নেয়। আর বাংলাদেশ ভারতীয় পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে নতুন করে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করে। এমন একটি পরাজয় ভারতের কাছে একেবারেই অকল্পনীয় ছিলে। বছরের পর বছর ধরে ভারত তার সমস্ত মেকানিজম ব্যবহার করেও কীভাবে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলো, তা গবেষণার বিষয় হয়ে থাকবে।
ভারতের চর শেখ হাসিনার জন্য এমন আসমানি গজব থেকে ভারত কোনো শিক্ষা নেয়নি । কিংবা বাংলাদেশকে পদানত করার চক্রান্ত থেকেও ফিরে আসেনি দেশটি। সচেতন মহল মনে করে, ভারত হাসিনার মতো আওয়ামী চোর-ডাকাত ও দেশদ্রোহীদের ওপর এখন আর পুরোপুরি নির্ভর করবে না। এর বদলে সে নানা অজুহাতে বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করতে পারে। ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সংবাদমাধ্যম, সেনা কর্মকর্তা, এমনকি কূটনীতিকদের প্রকাশ্য তৎপরতা ও মন্তব্য এবং হুমকি থেকে এর যথেষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
এ ধরনের তৎপরতার মুখে আমাদের নিষ্ক্রিয় থাকলে চলবে না। প্রতিরোধের অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি ছাড়াও আমরা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্বমঞ্চে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নিজস্ব উদ্যোগে যেকোনো সূত্র থেকে যেকোনো ধরনের সমরাস্ত্র সংগ্রহের অধিকার আমাদের রয়েছে। ভারতের কাছে আরো নমনীয় হওয়ার কোনো সুযোগ ও সময় আর নেই। এখন লড়াই করেই বাঁচতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ভারত একটি শতধাবিভক্ত জাতি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভেতরেও নানা ধরনের বিভক্তি বিরাজমান। ওরা সেনাবাহিনীতে চাকরি করে কাজের জন্য, দেশের জন্য নয়। চাকরির জন্য তারা জীবন হারাতে চায় না। রৌমারি-বড়ই বাড়ি, পদুয়ায় ভারতীয় সৈন্যদের পলায়ন ও আত্মসমর্পণের স্মৃতি এবং লজ্জা ভারতীয়দের এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়।
কিন্তু তথাকথিত পরাশক্তির অহংবোধে মত্ত ভারত তার চক্রান্ত থেকে মোটেই সরে যায়নি। ভারতীয় চক্রান্ত ও ভীতি থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত রাখতে হলে আমাদের অনেকগুলো বিকল্পের কথা এখনই ভাবতে হবে। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তারা অবশ্যই তা ভেবে দেখবে বলে আমার বিশ্বাস।
তবে ভারত থেকে আমাদের কিছু শেখারও আছে। অনুন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারত কোটি কোটি নাগরিককে অভুক্ত রেখে আণবিক বোমা বানিয়েছিল। আত্মমর্যাদা রক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না খেয়ে হলেও নিজের সমরাস্ত্র সক্ষমতা বাড়াতে হয়।
উপমহাদেশে আণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা ভারতই শুরু করেছে। ভারত তার আগ্রাসী নীতি তথা অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন থেকে সরে না এলে আমাদেরও ভিন্নপথে হাঁটতে হবে। শহীদ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, তিতুমীর, বখতিয়ার খলজির সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জিয়াউর রহমানের বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা ঘোষণা, স্বাধীনতা সংগ্রামে সফল জনযুদ্ধ, পঁচাত্তরে ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানকে ব্যর্থকরণ এবং ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার সফল অভ্যুত্থান আমাদের প্রেরণার উৎস। আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচার জন্য মানুষের লড়াই চিরন্তন। এই চিরন্তর লড়াই আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে হচ্ছে।
ভারত যা করছে, তার খেসারত তাকে অচিরেই দিতে হতে পারে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে দিয়ে ভারত ১৫-১৬ বছর ধরে যে নিপীড়ন চালিয়েছে, তার দায়-দায়িত্ব এক দিন ভারতকে বহন করতেই হবে। হিটলার যুদ্ধ করেছে সারা বিশ্বে তার জাতির কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। ভারতও শেখ হাসিনা দিয়ে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে নির্যাতন চালিয়েছে দেশপ্রেমিক জনগণকে নিশ্চিহ্ন করে বাংলাদেশকে চিরতরে গ্রাস করার জন্য। সেই চক্রান্তকে আমরা ব্যর্থ করে দিয়েছি। গণহত্যার জন্য হিটলার বাহিনীর বিচার হতে পারলে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগেরও বিচার হবে। সেই সঙ্গে তার প্রভু ভারতকেও একদিন তার এসব কৃতকর্মের জন্য ভুগতে হবে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া প্রবাসী, ৭১-এর মুক্তিযোদ্ধা, প্রবাসী সাংবাদিক ও গবেষক