নাশকতার লক্ষ্যে রাজধানীর ভাটারা থানার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার পাশে কে বি কনভেনশন সেন্টারে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র ও অনলাইন যুদ্ধের বিষয়ে প্রশিক্ষণের ঘটনায় মেজর সাদেকুল হক সাদেকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা পাওয়ায় মেজর সাদেকের বিরুদ্ধে তদন্ত আদালত গঠন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এছাড়াও তার কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে আরেকটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে আদালতের সুপারিশক্রমে সেনা আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
গতকাল শুক্রবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
আইএসপিআর জানায়, মেজর সাদেকের অনুপস্থিতিসংক্রান্ত কমান্ড রেসপন্সিবিলিটির বিষয়ে আলাদা আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দায় নিরূপণ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মেজর সাদেকের পেছনে কারা রয়েছেন, তা বের করার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা। অসুস্থতার অজুহাতে দীর্ঘদিন তাকে অনুপস্থিতির সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার পেছনে কারা রয়েছেন, তাও জানার চেষ্টা চলছে। নিরাপত্তা হেফাজতে নেওয়ার আগে কক্সবাজারের রামু ক্যান্টনমেন্টের কর্মস্থলে মেজর সাদেক ১৫০ থেকে ১৯৮ দিনের মতো অনুপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে। সেনাবাহিনীর তরফ থেকে প্রাথমিকভাবে বিষয়টি গোপন রাখা হলেও পুলিশ তৎপর হওয়ায় আর চাপা থাকেনি।
মেজর সাদেক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করা পিজিআরের প্রধান মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর হারুনের জামাতা। মেজর সাদেকের বর্তমান কমান্ডিং অফিসারও (সিও) এক সময় হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে তার খুবই বিশ্বস্ত লোকদের প্রথাগতভাবে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে।
আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্রতি একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাসংক্রান্ত অভিযোগ পাওয়া যায়। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনী বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ জুলাই ওই কর্মকর্তাকে তার নিজ বাসস্থান রাজধানীর উত্তরা থেকে আটক করে সেনা হেফাজতে নেয়া হয়। পূর্ণ তদন্ত সমাপ্তিসাপেক্ষে প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর প্রচলিত আইন ও বিধি অনুযায়ী যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সঙ্গে প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন করা হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার সেনা সদরে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে তাকে হেফাজতে নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। এর আগে মেজর সাদেকের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের বিষয়ে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করে ‘আমার দেশ’। তাকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেওয়ার বিষয়ও সংবাদে উল্লেখ করা হয়। এ নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
বৃহস্পতিবারের ব্রিফিংয়ে সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, এরকম ঘটনা জানার পর সেনাবাহিনীর হেফাজতেই তিনি আছেন। তদন্তে দোষ প্রমাণিত হলে নিঃসন্দেহে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সেনাবাহিনী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
কে বি কনভেনশন সেন্টারের প্রশিক্ষণের ঘটনায় গত ১৩ জুলাই ভাটারা থানায় একটি মামলা হয়। মামলায় প্রায় ৪০০ জনকে আসামি করা হয়। মামলাটির তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ। ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) নাসিরুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, এ পর্যন্ত ২২ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে অভিযান চলছে।
নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রশিক্ষণের মূল দায়িত্বে ছিলেন মেজর সাদেক ও তার স্ত্রী সুমাইয়া জাফরীন। মেজর সাদেকের সঙ্গে হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের যোগাযোগ রয়েছে। জয়ের নির্দেশেই তিনি ঢাকা শহরে আওয়ামী লীগকর্মীদের সংগঠিত করছেন বলে যে তথ্য বেরিয়েছে, তাও বের করার চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে সার্বিক তদন্তের স্বার্থে মেজর সাদেক ও তার স্ত্রীর মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ পাওয়া দরকার বলে জানা গেছে। বিমানবন্দর ও শাহবাগ দখল করে দুই থেকে তিন লাখ আওয়ামী নেতাকর্মীর সমাগম ঘটিয়ে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রসহ সার্বিক বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থা সমন্বিতভাবে কাজ করছে। রাজধানীতে এ পর্যন্ত হওয়া সবকটি গোপন প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া প্রায় সবাইকে চিহ্নিত করেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এ সংখ্যা প্রায় দুই হাজার ৫০০ বলে জানা গেছে। এছাড়া অর্থের জোগানদাতা হিসেবে একাধিক ব্যবসায়ীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। নজরদারিতে রাখা হয়েছে তাদের।
সরকার উৎখাতে আওয়ামী নাশকতার ছক অনুযায়ী এর আগেও রাজধানীর অন্তত চারটি স্থানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর মধ্যে সুরক্ষিত একটি স্থানেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বাছাই করা ক্যাডারদের। কলকাতার সল্টলেকের বাসায় বসে সরাসরি ঢাকার এসব প্রশিক্ষণসহ সার্বিকভাবে সরকার উৎখাতের পরিকল্পনার বিষয়টি তত্ত্বাবধান করছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তাকে সহযোগিতা করার জন্য তার সল্টলেকের বাসায় অবস্থান করছেন ডিএমপির পলাতক সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ কয়েকজন আওয়ামী নেতা ও পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা। অন্যদিকে দিল্লিতে অবস্থান করা পলাতক অতিরিক্ত আইজিপি ও এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম এবং ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান পলাতক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিবুর রহমান ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর নির্দেশনায় তাদের কৌশলগত সাপোর্ট দিচ্ছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, কে বি কনভেনশন সেন্টারে দেওয়া প্রশিক্ষণের ঘটনায় গত ১২ জুলাই উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকার ১১ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর রোডের ৮৩ নম্বর বাসা থেকে যুবলীগ নেতা সোহেল রানাকে গ্রেপ্তার করে ভাটারা থানা পুলিশ। আওয়ামী লীগ নেত্রী শামীমা নাসরিন শম্পাকে একই সেক্টরের ১০/বি রোডের ১০ নম্বর বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। শম্পার স্বামী সরকারি অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
জানা গেছে, গ্রেপ্তার সোহেল রানা, শামীমা নাসরিন শম্পা ও মেহেরপুরের যুবলীগ আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান রিটনকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করার পরিকল্পনাও রয়েছে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর। এরসঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীতে কর্মরত অফিসারদের মধ্যে আরো কেউ জড়িত কি না, তা বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সোহেল রানা এবং শম্পার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মেজর সাদেকের নির্দেশে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তৃণমূল আওয়ামী লীগকর্মীদের সংগঠিত করে বিভিন্ন স্থানে নাশকতা চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ভাটারা থানা এলাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার পাশে ই-ব্লকের ৭ নম্বর রাডের ৫৩/এ বাড়িতে অবস্থিত কে বি কনভেনশন সেন্টারের দ্বিতীয় তলা ভাড়া নেওয়া হয়। চারতলাবিশিষ্ট বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় গত ৮ জুলাই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মেজর সাদেক সেদিনের ওই কর্মশালার নামে সরকার উৎখাতে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সংস্থার মতে, কনভেনশন হলের ম্যানেজারের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে ম্যানেজার মুজাহিদকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ম্যানেজার পরিকল্পিতভাবে কনভেনশন হলের সব সিসি ক্যামেরা দিনভর বন্ধ রাখেন। আগাম তথ্য পাওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জালে আটক হওয়ার কারণে আরো একাধিক প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যায়।
আগামী ৫ আগস্টকে ঘিরে নাশকতা তৈরি করে, গুজব ছড়িয়েÑসর্বোপরি সশস্ত্রভাবে অবস্থান নিয়ে রাজধানীর শাহবাগ দখল করার পরিকল্পনা করেছিল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে আমার দেশ গত ২৮ জুলাই ‘দেশজুড়ে আওয়ামী নাশকতার ছক’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করলে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করে। ২৮ জুলাই রাতে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ সারা দেশে ছয় দফা নির্দেশনা দিয়ে সতর্কতা জারি করে।