সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে ২০০৭ সাল থেকে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমওইউতে খলাপি ঋণ আদায়, ঋণ প্রবৃদ্ধি যথাযথ রাখা, লোকসানি শাখা ও পরিচালন ব্যয় কমানো, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও সুপারভিশনের উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ছয় মাস পরপর ব্যাংকগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে এসব লক্ষ্য অর্জনের মূল্যায়ন করা হয়।
তবে এত বছরেও এ খাতের ব্যাংকগুলোর কোনোভাবেই আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। বরং দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংকের সঙ্গে তিন বছরের সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করতে যাচ্ছে। আগে যেটা এক বছরের জন্য করা হতো। খুব দ্রুত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে চুক্তি হবে। এই চুক্তিতে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিশ্বব্যাংক অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
ব্যাংকগুলো থেকে তিন বছর মেয়াদি পাঠানো পরিকল্পনা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমওইউ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর আগামী তিন বছরের জন্য ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ, শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে ঋণ আদায়, খেলাপির হার কমানো, শীর্ষ পাঁচ শাখার ঋণের ঘনত্ব কমানো, বড় গ্রাহকের ঋণ বন্ধ, অপারেটিং খরচ কমানো এবং শতভাগ সিবিএস বাস্তবায়নসহ নানা পরিকল্পনা জমা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃক উক্ত লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সন্তোষজনক অগ্রগতি দেখাতে ব্যর্থ হলে ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে ব্যর্থ হলে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হতো না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, চলতি বছরের মার্চ থেকে সব ব্যাংকে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন’ (পিসিএ) কার্যকর হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলোর যে অবস্থা তাতে পিসিএ তাদের ওপর বাস্তবায়ন হলে এসব ব্যাংকের আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তিন বছরে উন্নতি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এ খাতের ব্যাংগুলোকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংকগুলোর আর্থিক চিত্র
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সাল শেষে সোনালী ব্যাংকের আমানত দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ১৫ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালে ছিল ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। গত বছর শেষে ব্যাংকের ঋণ স্থিতি ছিল ৯০ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা, তার আগের বছর এই ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮০৫ কোটি টাকা। গত বছর আমানত বাড়লে ব্যাংকটির বিনিয়োগ কমেছে। অপরদিকে ২০২৩ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ১৩ শতাংশ থেকে বেড়ে গত বছর শেষে দাঁড়িয়েছে ১৮ শতাংশ। ২০২৪ সালে সোনালী ব্যাংক ৩৭১ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। গত বছর ব্যাংকটি খেলাপি থেকে ৫৬৭ কোটি টাকা আদায় করেছে। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ গ্রাহক থেকে আদায় মাত্র ৭ কোটি টাকা। ৫ আগস্টের পর এই ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো পর্যবেক্ষক নেই।
সোনালী ব্যাংকের অবস্থা এ খাতের অন্য ব্যাংকের তুলনায় মোটামুটি ভালো। তবে জনতা ব্যাংকের অবস্থা খুবই খারাপ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের আমানত দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালে ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। গত বছর শেষে ব্যাংকের ঋণ স্থিতি ছিল ৯৩ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা, তার আগের বছর এই ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৭ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। গত বছর আমানত ও ঋণ দুটিই কমেছে। অপরদিকে ২০২৩ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ২৭ শতাংশ থেকে বেড়ে গত বছর শেষে দাঁড়িয়েছে ৭২ শতাংশ। ২০২৪ সালে জনতা ব্যাংক ৪২ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। এতে করে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে ৫২ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। গত বছর ব্যাংকটি খেলাপি থেকে ৩৫৮ কোটি টাকা আদায় করেছে। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ গ্রাহক থেকে আদায় মাত্র ৫৫ কোটি টাকা। এই ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো পর্যবেক্ষক নেই।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পর্যবেক্ষক থাকার পরও ব্যাংকগুলো ফাঁকফোকরে নানা অনিয়ম করে গেছে। এখন তো কোনো পর্যবেক্ষক নেই। ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষক না থাকা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই দ্রুত পর্যবেক্ষক দেওয়া দরকার।
২০২৪ সাল শেষে অগ্রণী ব্যাংকের আমানত দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৪৯ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালে ছিল ৯৭ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। গত বছর শেষে ব্যাংকের ঋণ স্থিতি ছিল ৭২ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা, তার আগের বছর এই ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৯ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। গত বছর আমানত ও ঋণ দুটিই বেড়েছে। অপরদিকে ২০২৩ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ২৮ শতাংশ থেকে বেড়ে গত বছর শেষে দাঁড়িয়েছে ৩৮ শতাংশের বেশি। ২০২৪ সালে অগ্রণী ব্যাংক ৮ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। এতে করে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে ৪ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। গত বছর ব্যাংকটি খেলাপি থেকে ৪৪১ কোটি টাকা আদায় করেছে। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ গ্রাহক থেকে আদায় মাত্র ৪৩ কোটি টাকা।
রূপালী ব্যাংকের গত বছর শেষে আমানত দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালে ছিল ৬৫ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। গত বছর শেষে ব্যাংকের ঋণ স্থিতি ছিল ৪৭ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা, তার আগের বছর এই ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার ৬০ কোটি টাকা। গত বছর আমানত ও ঋণ দুটিই বেড়েছে। অপরদিকে ২০২৩ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে গত বছর শেষে দাঁড়িয়েছে ৩২ শতাংশের বেশি। ২০২৪ সালে রূপালী ব্যাংক ৭ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। এতে করে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে ৫ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। গত বছর ব্যাংকটি খেলাপি থেকে ৩৮১ কোটি টাকা আদায় করেছে। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ গ্রাহক থেকে আদায় মাত্র ৪৫ কোটি টাকা।