আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোজা শুরুর আগে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শেষ করতে নির্বাচন কমিশনকে এরই মধ্যে চিঠি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। চিঠি দেওয়ার একদিন পর গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মোহাম্মদ সানাউল্লাহ নির্বাচন ভবনে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আগামী ডিসেম্বর মাসে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে।
এর ফলে নির্বাচনরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠায় ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আজ শুক্রবার থেকেই রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে মিত্র দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু হবে। আজ বেলা ৩টায় একত্রে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও এলডিপিসহ কয়েকটি দল এবং আগামীকাল শনিবার বিকাল ৫টায় গণতন্ত্র মঞ্চ, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যসহ অন্য দলগুলোকে নিয়ে একত্রে এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
বৈঠক প্রসঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক আমার দেশকে বলেন, সরকারের তরফে নির্বাচনের একটি পথনকশা দেওয়া হয়েছে। এতে দেশে একটি নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা যারা যুগপৎ আন্দোলনে ছিলাম, সেসব দলের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বৈঠক করবেন।
তিনি মনে করেন, অনুমান করছি প্রথমত এ বৈঠকে অনেকটা সৌজন্য বা শুভেচ্ছামূলক আলোচনা হবে। আশা করি, এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তী বৈঠকগুলোয় হয়তো নির্বাচন, আসন বণ্টন বা আরো কিছু নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে।
এদিকে বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, তারেক রহমানের বৈঠকের পাশাপাশি চলতি সপ্তাহের মধ্যে যুগপতের মিত্রদের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়েও প্রাথমিক আলোচনা শুরু করতে পারে বিএনপি। সম্প্রতি দলটির পক্ষ থেকে মিত্রদের অনেকের কাছে আসনের তালিকা চাওয়া হয়েছে। মূলত এ বৈঠকে মিত্রদের পক্ষ থেকে তাদের প্রত্যাশিত আসনের তালিকা বিএনপিকে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বৈঠকের সম্ভাব্য আলোচনা প্রসঙ্গে ১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, দীর্ঘদিন পর নির্বাচন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট ঘোষণা এসেছে। এরপরই আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই-সংগ্রাম করেছি, তাদের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বৈঠক করবেন। আমার মনে হয়, এ বৈঠকে তারেক রহমান সৌজন্যমূলক কথা বলবেন। আমরা যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ছিলাম, তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করবেন। একই সঙ্গে আগামীতেও ফ্যাসিবাদবিরোধী এ ঐক্য যাতে অটুট থাকে, সেটার ওপরও তিনি গুরুত্ব দেবেন।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে ১২ দলীয় জোট, ১০ দলীয় জোট ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’, ছয়দলীয় জোট ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’, চারদলীয় জোট ‘গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য’, এলডিপি, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, এনডিএম, গণফোরাম-বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি) ও বাংলাদেশ লেবার পার্টি সম্পৃক্ত ছিল। অবশ্য আন্দোলন চলাকালে ১২ দলীয় জোট থেকে নিবন্ধিত দুটি দল বেরিয়ে গিয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, দীর্ঘ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর মধ্য থেকে যাদের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মতো সম্ভাবনা রয়েছে, আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে তাদের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেবে তাদের দল। এক্ষেত্রে আসন ছাড়ার পরিকল্পনাও রয়েছে দলটির। এর বাইরে জোটের ঐক্যের স্বার্থেও কিছু আসন ছাড়বে বিএনপি।
বিএনপি যখন যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে, তখন এ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত দলগুলোকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল—আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠন একসঙ্গে করা হবে।
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির নির্বাচনি সমঝোতা হবে কি না, এখনো তা স্পষ্ট নয়। তবে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি বিএনপির নীতিনির্ধাকরা। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এনসিপির জন্য আলোচনার দরজা খোলা রয়েছে।
জোটের বিষয়ে তিনি গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত সমমনা যে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট হতে পারে। তবে জোটের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
জানা গেছে, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ কয়েকটি ইসলামি দল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করে যুগপতের বাইরে নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছিল। নির্বাচনি জোটে সম্পৃক্ত হলে বিএনপি তাদেরও কয়েকটি আসন দিতে পারে। মূলত বিএনপি নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের জোটই ‘নির্বাচনি জোটে’ রূপ নেবে। তবে দলগুলোর মধ্যে যারা সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলনে ছিল না, আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে তাদের বিষয়টি বিবেচনায় নেবে না বিএনপি।
সবশেষ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল বিএনপি। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় তখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে তারা নির্বাচন করেছিল। বিএনপি তখন শরিকদের জন্য ৫৯টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল। এর মধ্যে জামায়াতসহ তৎকালীন ২০ দলীয় জোটকে ৪০টি আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ছেড়েছিল ১৯টি আসন।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলীয় জোটের হয়ে বিএনপির ধানের শীষ কিংবা নিজেদের দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করেছিলেন তারা। নিবন্ধন না থাকায় তখন বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে ভোট করেছিলেন জামায়াতের প্রার্থীরা।
ওই নির্বাচনে তৎকালীন ২০ দলীয় জোটভুক্ত জামায়াতকে ২২টি, এলডিপিকে পাঁচটি, জাতীয় পার্টিকে (কাজী জাফর) দুটি, খেলাফত মজলিসকে দুটি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশকে চারটি, কল্যাণ পার্টিকে একটি, লেবার পার্টিকে একটি, এনপিপিকে একটি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিকে (বিজেপি) একটি এবং পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশকে (পিপিবি) একটি আসন ছেড়েছিল বিএনপি। অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত গণফোরামকে সাতটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডিকে চারটি, নাগরিক ঐক্যকে চারটি এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগকে চারটি আসন ছেড়ে দিয়েছিল।
২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিএনপির নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন শুরুর আগে ৯ ডিসেম্বর ‘২০ দলীয় জোট’ বিলুপ্ত করা হয়। পরবর্তীতে বিলুপ্ত করা জোটের অধিকাংশ দল মিলে নতুন করে ১২ দলীয় জোট এবং জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট গঠন করে যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। এছাড়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কয়েকটি দল নিয়ে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ গঠিত হয়, ছয়দলীয় এই জোটও সম্পৃক্ত ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনে।