আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে শেরপুর জেলার তিনটি সংসদীয় আসনে নির্বাচনি হাওয়া বইছে। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। নানা কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন দলগুলোর মনোনীত ও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা।
ভোটের মাঠে এবার আওয়ামী লীগ না থাকায় শেরপুরের তিনটি আসনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীদের মধ্যে লড়াই হবে। তবে ভোটের হিসাবনিকাশ পাল্টে দিতে পারে ইসলামপন্থিদের সম্ভাব্য জোট। সেটি হলে যে কোনো প্রার্থীকে তাদের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।
এবার নিজেদের হারানো তিনটি আসন পুনরুদ্ধার করতে চায় বিএনপি। অন্যদিকে এসব আসনের ভোটে ভাগ বসাতে চায় জামায়াত। নিজেদের নির্দিষ্ট ভোটারের বাইরেও এবার অন্যদের মন জয় করতে ছুটে চলেছেন দলটির প্রার্থীরা। পাশাপাশি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে।
এদিকে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ তিনটি আসনে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দুটি আসনে ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস দুটি আসনে তাদের মনোনীত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছেন। স্থানীয় ভোটাররা বলেন, গণতন্ত্র বিকাশ এবং দেশের উন্নয়নে ভালো নির্বাচনের বিকল্প নেই। তারা আশাবাদী দীর্ঘদিন পর সরাসরি কেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন। এটি বাস্তবায়িত হলে সরকারের নয় জনগণের নির্বাচিত তাদের জন্য কাজ করবে এমন প্রতিনিধিরা সংসদে যাবেন বলেও আশাবাদী তারা।
শেরপুর-১ (শেরপুর সদর)
১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন বিএনপির প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী ও সাংবাদিক মরহুম খোন্দকার আব্দুল হামিদ। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন বিএনপির প্রার্থী সাবেক উপসচিব মরহুম মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। এরপর থেকে আসনটি বিএনপির হাতছাড়া। দীর্ঘসময় শেরপুর সদর আসনটি দখলে থেকেছে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ও আওয়ামী লীগের হাতে। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন শেরপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. সানসিলা জেবরিন প্রিয়াংকা ও শেরপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও জেলা যুবদলের শফিকুল ইসলাম মাসুদ।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে কম বয়সি প্রার্থী ছিলেন প্রিয়াংকা (২৫ বছর)। অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী শফিকুল ইসলাম মাসুদ ২০১৯ সালে শেরপুর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। ইতোমধ্যে তারা দুজনই জনসংযোগের পাশাপাশি দলের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হাফেজ রাশেদুল ইসলাম। তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি। ভোটের মাঠে সরব উপস্থিতি জানান দিতে তিনি নিয়মিত জনসংযোগ করছেন। আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী হাসান ইমাম ওয়াফি। তিনি জামায়াতের সাবেক কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মরহুম মো. কামারুজ্জামানের চতুর্থ সন্তান। শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে তার প্রতি রয়েছে এলাকার মানুষের সহানুভূতি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মনোনয়নপ্রত্যাশী দলটির শেরপুর জেলার প্রধান সমন্বয়কারী প্রকৌশলী মো. লিখন মিয়া। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মনোনয়নপ্রত্যাশী শেরপুর জেলা কমিটির সভাপতি হাফেজ মাওলানা ফারুক আহমদ। খেলাফত মজলিস বাংলাদেশের মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা কমিটির সভাপতি মাওলানা আব্দুল হালিম। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রার্থী শেরপুর জেলা কমিটির সভাপতি মাওলানা শফিকুল ইসলাম, গণঅধিকার পরিষদের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন শেরপুর জেলার আহ্বায়ক আরিফ আহমেদ ও সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এসএম শহিদুল ইসলাম সোহাগ।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ডা. সানসিলা জেবরিন প্রিয়াংকা বলেন, ‘একটি দলের মধ্যে গঠনমূলক প্রতিযোগিতা থাকবেই, তাই বলে গ্রুপিং করে আমাদের ধানের শীষের প্রতীককে অসম্মানিত করব না। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আমরা শেরপুরের তিনটি আসন উপহার দেব। আমি আশাবাদী শেরপুরের জনগণ আমাকে সাদরে গ্রহণ করবে।’
বিএনপির আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ‘দলের দুর্দিনে যাকে সব সময় কাছে পেয়েছে, দল তাকেই বেছে নেবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠের নেতাদের দল মূল্যায়ন করবে। আমি আশাবাদী দলের মনোনয়ন পাব।’
জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হাফেজ রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অবহেলিত জনপদ শেরপুরে জামায়াতে ইসলামী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করেছে। শেরপুরের মাটি এবং মানুষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক দীর্ঘ ও সুদৃঢ়। তবে এবার আমরা একটু অ্যাডভান্স। নতুন বাংলাদেশ মূলত ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের পথে চলছে। তাই আমরা মানুষের কথা শোনা কর্তব্য মনে করছি। এখন পর্যন্ত আমরা যা মতামত পেয়েছি তাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বেকারত্ব দূরীকরণ, মাদকমুক্ত করার বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে আমাদের।’
রাশেদুল ইসলাম আরো বলেন, ‘আমরা মনে করছি শহীদ কামারুজ্জামানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে নতুন শেরপুর গড়ার টার্গেটে সবাই মিলে আমরা তা (জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন) করব এবং এটা আমরা দায়িত্ব মনে করি।’
শেরপুর-২ (নকলা-নালিতাবাড়ী)
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও শেরপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফাহিম চৌধুরী, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও শেরপুর সরকারি কলেজের সাবেক জিএস ফজলুর রহমান তারা, জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও নালিতাবাড়ী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান একেএম মুখলেছুর রহমান রিপন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা ও জাপান প্রবাসী দুলাল চৌধুরী এবং কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক আমেরিকা প্রবাসী ইলিয়াস খান।
জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় বিতর্ক সম্পাদক মু. গোলাম কিবরিয়া ভিপি। তিনি শেরপুর জেলা জামায়াতের কর্ম পরিষদ সদস্য ও প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি। নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি তার আসনের সব ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড চষে বেড়াচ্ছেন। ভোটারদের মন জয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন জেলা কমিটির ১ নম্বর যুগ্ম সমন্বয়কারী আলমগীর কবির মিথুন ও শ্রমিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় সংগঠক তৌহিদুর রহমান সাঈদ। এবি পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মো. আব্দুল্লাহ। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী দলটির নালিতাবাড়ী উপজেলা শাখার জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মাওলানা মো. আব্দুল্লাহ আল-কায়েস। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মনোনয়নপ্রত্যাশী মুফতি মো. মোখলেসুর রহমান। গণঅধিকার পরিষদের মনোনয়নপ্রত্যাশী দলটির জেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী হায়াত। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মনোনয়নপ্রত্যাশী মাওলানা মোখলেছুর রহমান।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ফাহিম চৌধুরী বলেন, বিগত সময়ে বিএনপির নির্যাতিত নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম, এখনো আছি। এবারও আমি শতভাগ আশাবাদী দল আমাকে মনোনয়ন দেবে। নির্বাচিত হলে বাবার (সাবেক হুইপ জাহেদ আলী চৌধুরী) অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন ও এলাকার সার্বিক উন্নয়নে কাজ করব।
জামায়াত প্রার্থী মু. গোলাম কিবরিয়া ভিপি বলেন, ‘আমি জামায়াতের সর্বকনিষ্ঠ একজন এমপি প্রার্থী। বৈষম্যহীন উন্নয়নের ধারায় নকলা ও নালিতাবাড়ী উপজেলাকে গড়তে চাই। আমি আশাবাদী এলাকার জনগণ ও তরুণ ভোটাররা পাশে থেকে আমাকে সমর্থন দিয়ে বিজয়ী করবেন, ইনশাআল্লাহ।’
শেরপুর-৩ (শ্রীবরদী-ঝিনাইগাতী)
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও শেরপুর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মাহমুদুল হক রুবেল এবং বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য প্রথিতযশা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট একেএম আমিনুল হক।
জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী শেরপুর জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মু. নুরুজ্জামান বাদল। এনসিপির মনোনয়নপ্রত্যাশী দলটির শেরপুর জেলার যুগ্ম সমন্বয়কারী লুৎফর রহমান লাজু। এবি পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক জামায়াত নেতা মাহবুব উল আলম। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী জাতীয় উলামা মাশায়েখ আয়িম্মা পরিষদের শেরপুর জেলা সভাপতি মুফতি আবু তালেব মো. সাইফুদ্দিন।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মনোনয়নপ্রত্যাশী শেরপুর জেলা কমিটির যুগ্ন সম্পাদক মুফতি শামীম আল রাজি। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রার্থী হাফেজ আনিসুর রহমান। গণঅধিকার পরিষদের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন শেরপুর জেলা কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব ও ঝিনাইগাতী উপজেলার আহ্বায়ক ইঞ্জিনিয়ার মো. মনিরুজ্জামান, জেলা কমিটির কার্যকরী সদস্য মাহমুদুল হাসান এবং শেরপুর যুব অধিকার পরিষদের সেক্রেটারি আবীর আহমেদ সুজন।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী মাহমুদুল হক রুবেল বলেন, ‘এ আসনটি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। আমি এই আসনের তিনবারের নির্বাচিত সাবেক এমপি। বিগত ১৭ বছর আওয়ামী লীগ পুলিশ কর্তৃক বিএনপির নির্যাতিত নেতাকর্মীদের পাশে থেকে তাদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছি, এখনো করছি। আমি এবারও আশাবাদী দলের মনোনয়ন পাব, আর মনোনয়ন পেলে অবশ্যই জয়লাভ করব। বিএনপি সরকার গঠন করলে ২০০১ সালের মতো এলাকায় উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখব।’
জামায়াত প্রার্থী মু. নুরুজ্জামান বাদল বলেন, ‘সীমান্তঘেঁষা এই পাহাড়ি এলাকার প্রতিটি ঘরে শিক্ষার আলো ছড়াতে চাই। মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গড়তে চাই। এই এলাকাকে আধুনিক পর্যটন এলাকা হিসেবে দেখতে চাই। দেশের মানুষ পরিবর্তন ও সৎ নেতৃত্ব চায়। আমার প্রত্যাশা এলাকার সব মানুষ ন্যায়-ইনসাফের প্রতীক দাঁড়িপাল্লাকে বিজয়ী করবে, ইনশাআল্লাহ।’