কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর ও ছয় ডেপুটি গভর্নরের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সবার অ্যাকাউন্টের তথ্য তলব করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সাবেক তিন গভর্নর হলেন- ড. আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার।
বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেছেন এই তিনজন। এই সাড়ে ১৫ বছরে তাদের নেতৃত্বেই ব্যাংক খাত ধ্বংস করা হয়। এর মধ্যে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের সময়কালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিতে ছিল দুর্বলতা। এ সুযোগে সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। আবার তার সময়েই ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বেসরকারি উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আতিউর রহমানের সময় সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি। রিজার্ভ চুরির ধামাচাপা দেওয়ার ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিলেন আতিউর। এ ঘটনার পরই তিনি পদত্যাগ করেন।
এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নেন সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবির। তার মাধ্যমেই ২০১৭ সালের শুরুতে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ও পরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দখল করে বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপ। গভীর রাতে ও বাসায় বসে এই দখল অনুমোদন দেন ফজলে কবির। এরপর এসব ব্যাংকে লুটপাট শুরু হলে তিনি তদারকি কমিয়ে দেন।
এ ছাড়া ঋণ নীতিমালায় ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ গোপন করা ও সুদের হার ৯ শতাংশে আটকে রাখা এবং নামমাত্র টাকা দিয়ে খেলাপি থেকে মুক্ত থাকার পদ্ধতি চালু হয় তার আমলে। ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে অনেক ব্যবসায়ী এসব টাকা বিদেশে পাচার করেন।
ফজলে কবিরের মেয়াদ শেষে আরেক অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হন। দুই বছরের মাথায় তিনি যত বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছিল সব নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গোপন স্থান থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। তার আমলেও আগের মতো বেনামে ঋণ ও জালিয়াতি করে ঋণ বিতরণের ধারা অব্যাহত থাকে। তিনি অনিয়ম বন্ধে উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হন। পরে অনিয়মে যুক্ত ব্যবসায়ীদের সহযোগী হয়ে পড়েন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তিনি এসেই ঋণখেলাপিদের বড় ছাড় দিয়ে নতুন এক নীতিমালা জারি করেন। আবার তার সময়েই এস আলমের ব্যাংকগুলোকে টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হয়। এসব টাকাও ঋণের নামে তুলে নেয় এস আলম গ্রুপ।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন সাবেক এ তিন গভর্নর। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হাসিনার পতনের পর দেশ থেকে পালিয়ে যান আতিউর। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তার পাসপোর্ট ব্লক করেছে সরকার। ফজলে কবির দেশেই রয়েছেন, তবে হাসিনার পতনের পর তাকে জনসম্মুখে দেখা যায়নি। আর ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে চলে যান আব্দুর রউফ । তিনি দেশে আছেন।
অপরদিকে, ব্যাংক হিসাব তলব করা সাবেক ছয় ডেপুটি গভর্নর হলেন- সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী (এসকে সুর), মাসুদ বিশ্বাস, এসএম মনিরুজ্জামান, আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান, কাজী ছাইদুর রহমান এবং আবু ফরাহ মোহাম্মদ নাছের।
এদের মধ্যে সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী ও বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বর্তমানে দুদকের মামলায় জেলহাজতে আছেন। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামান দায়িত্ব পেয়ে ব্যাংকগুলোর পরিদর্শন বন্ধ করে দেন।
বিএফআইইউয়ের সাবেক প্রধান রাজী হাসানের সময়ে অর্থপাচার হলেও তিনি প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। অভিযোগ রয়েছে, ডলার বাজারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন কাজী ছাইদুর রহমান এবং ঋণ নীতিমালা শিথিলের মাধ্যমে পুরো ব্যাংক খাতকে বিপর্যস্ত করে ফেলেন আবু ফরাহ মোহাম্মদ নাছের।