১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে প্রতিবছর ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত যথাক্রমে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে আসছে। ভারতের এই দিবসটি বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় এক ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতির কথা—তৎকালীন কংগ্রেস নেতারা মুসলমানদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, নতুন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ভারতের অন্য নাগরিকদের মতো তারাও সমান মর্যাদা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ভোগ করবেন। ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র ও আইনের চোখে সকল নাগরিকের সমান মর্যাদা নিশ্চিত করা ছিল ভারতের রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারের অন্যতম ভিত্তি।
কিন্তু পরবর্তীতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থানে সেই প্রতিশ্রুতি ধূলিসাৎ হয়েছে। ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তান-ভারত প্রসঙ্গকে সামনে এনে বিজেপি ও তার মতাদর্শীরা ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তরের আন্দোলন শুরু করেছে। এর ফলেই আজকের ভারতে মুসলমানরা অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন। মুসলিম লীগ নেতারা ১৯৪০-এর দশকেই আশঙ্কা করেছিলেন—কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারতীয় মুসলমানরা একসময় প্রান্তিক, বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার হবে। আজকের বাস্তবতা তাদের সেই সতর্কবার্তাকে সত্য প্রমাণ করছে।
২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ভারতীয় মুসলমানদের ওপর এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই আইনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের নামে মুসলমানদের লক্ষ্য করে গ্রেপ্তার ও হয়রানির ঘটনা ঘটছে। অমুসলিমদের কাগজপত্র না থাকলেও নাগরিকত্ব বহাল থাকছে, কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে কাগজপত্র না থাকলেই নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে গরিব ও প্রান্তিক মানুষদের জন্য নাগরিকত্ব প্রমাণের মতো কাগজপত্র সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব।
সম্প্রতি কাশ্মীরের ঘটনায় মুসলমানদের ওপর দমন অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে “অবৈধ বাংলাদেশি” শনাক্তের নামে বাংলাভাষী মুসলমানদের আটক, ক্যাম্পে প্রেরণ ও সীমান্তে পুশব্যাক করা হচ্ছে। এমনকি যাদের কাছে বৈধ নাগরিকত্ব প্রমাণপত্র রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রেও পুলিশ কোনো শুনানি ছাড়াই একই আচরণ করছে। ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, বিহারসহ বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচনের আগে মুসলিমদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এটি ১৯৪৭ সালে মুসলমানদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও মুসলমানদের কোণঠাসা করা হচ্ছে। বলিউডে মুসলিম চরিত্রকে ক্রমাগত সন্ত্রাসী বা ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। গরুর মাংস নিষিদ্ধ করার পর মুসলিম কসাই ও ব্যবসায়ীদের জীবিকা বিপন্ন হয়েছে, হামলা ও হত্যার শিকার হয়েছেন অনেকে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মিথ্যা অভিযোগে মুসলিম বাড়িঘর ও ব্যবসা ধ্বংস করা হচ্ছে।
রাজনীতিতেও মুসলমানদের উপস্থিতি প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভায় মুসলিম প্রতিনিধিত্ব সীমিত হয়ে পড়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে উর্দু ভাষা দীর্ঘদিন আগে বাদ দেওয়া হয়েছিল; আজ সেটি আরও বড় পরিসরে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মুছে দেওয়ার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সব মিলিয়ে, ভারতের প্রতিষ্ঠার সময় মুসলমানদের দেওয়া সমান অধিকার ও মর্যাদার প্রতিশ্রুতি আজ বিজেপি সরকারের নীতির কাছে ভঙ্গ প্রতিশ্রুতিতে পরিণত হয়েছে। নাগরিকত্ব আইন থেকে শুরু করে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা—সবকিছু মিলিয়ে মুসলমানদের এখনকার ভারতীয় রাষ্ট্রে টিকে থাকার লড়াই যেন এক অনন্ত অস্তিত্ব সংকট।