আমাদের ঘরে ছোট্ট এক খুদে সদস্য আছে, যে সারাক্ষণই কিছু না কিছু করছে। কখনো ঘর এলোমেলো করছে, কখনো আমাদের প্রিয় ফুলদানি হাতে নিয়ে হাঁটছে, আবার কখনো অবিরাম প্রশ্ন করে যাচ্ছে— “এটা কেন?”, “ওটা কীভাবে হলো?”। বেশিরভাগ বাবা-মা এ পরিস্থিতিকে সামাল দিতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে যান এবং প্রায়ই বকাঝকা করেন। কিন্তু মনোবিজ্ঞান বলছে, এই দুষ্টুমি ও কৌতূহলই শিশুর সুস্থ বিকাশের অন্যতম চাবিকাঠি।
দুষ্টুমি শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের অংশ
টুকটাক দুষ্টুমি করা, অগোছালো করা, কথা না শোনা— এগুলো আসলে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। শিশু যখন তার চারপাশের জগতকে আবিষ্কার করতে শুরু করে, তখন তার মধ্যে এক ধরনের অদম্য কৌতূহল জন্মায়। সে জানতে চায়, স্পর্শ করতে চায়, চেষ্টা করে দেখতে চায়।
শিশুমনোবিজ্ঞানী ড. সায়মা রহমান বলেন:
“বুদ্ধিমান ও অনুসন্ধিৎসু শিশুরা সাধারণত বেশি চঞ্চল হয়। তারা চারপাশের জিনিসগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, প্রশ্ন করে, নতুন কিছু শেখার জন্য উৎসুক থাকে। এটি তাদের ভবিষ্যৎ শেখার ক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাস গঠনে সহায়ক।”
অবাধ্যতা মানেই সমস্যা নয়
আমরা প্রায়ই শিশুর ‘না মানা’কে অবাধ্যতা হিসেবে দেখি। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি অনেক সময় শিশুর স্বাধীন চিন্তাশক্তি ও আত্মবিশ্বাসের লক্ষণ। যখন একটি শিশু কিছু করতে চায় এবং তার প্রতি দৃঢ় থাকে, তখন সেটি তার ব্যক্তিত্ব গঠনের ইঙ্গিত দেয়।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন,
“যে শিশু তার মতামত জানাতে সাহসী এবং নিজের পছন্দের বিষয়ে দৃঢ় থাকে, সে ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম, আত্মবিশ্বাসী ও নেতৃত্বগুণসম্পন্ন মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে।”
অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞার বিপদ
শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের পথে বড় বাধা হলো আমাদের অতিরিক্ত ‘না’। “এটা করোনা”, “ওটা ধরোনা”, “থামো”— এমন শব্দের বন্যায় শিশুর মনে ভয়, সংকোচ ও আত্মবিশ্বাসহীনতা জন্মায়। ধীরে ধীরে সে নতুন কিছু জানতে চাওয়া বন্ধ করে দেয়, সৃজনশীলতা হারায় এবং আত্মবিশ্বাস কমে যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশুকে সবসময় বাধা দেওয়া হয়, তারা বড় হয়ে ঝুঁকি নিতে চায় না, নতুন কিছু চেষ্টা করতে ভয় পায় এবং প্রায়ই সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়।
কি করবেন অভিভাবকরা?
১. দুষ্টুমিকে শেখার সুযোগে পরিণত করুন
শিশু যদি কাপ নিয়ে খেলতে চায়, তাকে নিরাপদ প্লাস্টিক কাপ দিন। যদি সে আঁকিবুঁকি করে, তাকে কাগজ-কলম দিন।
২. প্রশ্নের উত্তর দিন ও কৌতূহল বাড়ান
শিশুর প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেয়া জরুরি। উত্তর না জানলে একসঙ্গে খুঁজে দেখুন। এতে তার শেখার আগ্রহ বাড়বে।
৩. অতিরিক্ত বকাঝকা নয়, ধৈর্য ধরুন
বাচ্চারা বড়দের মতো “বুঝ” নিয়ে চলে না। তাই ধৈর্যশীল হোন, কঠোরতা নয়—দিকনির্দেশনা দিন।
৪. ইতিবাচক ভাষা ব্যবহার করুন
“না” না বলে বিকল্প দিন। যেমন, “ওটা ভাঙতে পারো না, এসো এর বদলে এই খেলনাটা দেখি।”
শেষ কথা
শিশুর দুষ্টুমি, চঞ্চলতা ও অবাধ্যতা কোনো নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য নয়। বরং এগুলো তার বুদ্ধিমত্তা, আত্মবিশ্বাস ও সৃজনশীলতার স্বাক্ষর। আমাদের উচিত এসব বৈশিষ্ট্যকে দমন না করে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে বিকশিত করা।
একজন সচেতন অভিভাবক তার সন্তানের ছোট ছোট দুষ্টুমির ভেতরেই ভবিষ্যতের সফলতার বীজ দেখতে পান। তাই বিরক্তি নয়, ধৈর্য ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে শিশুকে তার নিজস্ব সত্ত্বায় বড় হতে দিন।