নিঃসন্দেহে আমাদের আজকের পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিক্ষা ও মানবাধিকারের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তবু প্রশ্ন থেকে যায় এ প্রগতির যুগেও কেন বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ থামছে না? কোভিডের মতো ভয়াবহ অভিজ্ঞার পরও মানুষ কী কিছু শিখল না? কেন নতুন নতুন যুদ্ধের জন্ম হচ্ছে, আর পুরনোগুলো কখনো শেষ হয় না? যুদ্ধ কী শুধু রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিরোধ, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরো গভীর কোনো স্বার্থ?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে বর্তমান যুদ্ধব্যবস্থার প্রকৃত চালিকাশক্তির দিকে যেখানে মানবতা নয়; বরং মুনাফা, অস্ত্র ব্যবসায় ও ভূরাজনৈতিক আধিপত্য হয়ে উঠেছে মূল প্রতিপাদ্য। আজকের বিশ্বে যুদ্ধ আর কেবল ভূখণ্ড, মতাদর্শ বা আত্মরক্ষার বিষয় নয়। যুদ্ধ এখন এক বিশাল বাণিজ্য। মুনাফা করার ব্যবসায় রূপ নিয়েছে। এ মুনাফাভিত্তিক যুদ্ধব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি ‘মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স’ (এমআইসি); যারা অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানি, প্রতিরক্ষা ঠিকাদার, লবিস্ট, থিংক ট্যাংক ও গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানের জোট।
তাদের প্রধান লক্ষ্য পৃথিবী যেন কখনো সম্পূর্ণ শান্তিতে না থাকে। যাতে অস্ত্র, নজরদারি প্রযুক্তি ও সামরিক লজিস্টিকের চাহিদা সবসময় বজায় থাকে। যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা বিরোধ সৃষ্টি হয়, তারা সেখানে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বন্ধ করে দিয়ে মানুষের মধ্যে ‘যুদ্ধই একমাত্র সমাধান’-এ বিশ্বাস গেঁথে দেয়। তারা এক অঞ্চল থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়ায় কখনো মধ্যপ্রাচ্য, কখনো ইউক্রেন, কখনো আফ্রিকা বা পূর্ব এশিয়ায়, যতক্ষণ না সেখানে যুদ্ধ বাধে। আর যেহেতু মূলধারার গণমাধ্যম অনেকটাই তাদের নিয়ন্ত্রণে, তারা সংবাদ পরিবেশন করে যুদ্ধের পক্ষে, শান্তির পক্ষে নয়। মানুষের মনে সঙ্ঘাতকে ‘ন্যায্য’ ও ‘অপরিহার্য’ হিসেবে তুলে ধরে। রাজনীতিবিদরা কীভাবে যুদ্ধব্যবসার দালাল হয়ে উঠলেন? আধুনিক গণতন্ত্র, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিবিদরা অনেকাংশে মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের প্রতিনিধিতে পরিণত হয়েছেন। অনেকে সামরিক শিল্প মালিকদের কাছে থেকে তাদের নির্বাচনী প্রচারে অর্থ সহায়তা পান। আইন ও বৈদেশিক নীতিমালা লেখেন লবিস্টদের বুদ্ধিতে। আবার অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরাও অস্ত্র কোম্পানির সিইও পদে বসার সুযোগ পান। ফলে যুদ্ধ ও শান্তি নিয়ে সিদ্ধান্ত আর নৈতিকতা বা জনস্বার্থের ভিত্তিতে হয় না; বরং হয় বিনিয়োগকারীদের লাভ মাথায় রেখে। যদিও আমরা দেখি ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরোধী কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন (যেমন-আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার)। কিন্তু একইসাথে ইসরাইলের আগ্রাসনকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেন। তিনিও মার্কিন জনগণের করের টাকা খরচ করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সহায়তা পাঠান। আর সেটি এমন এক রাষ্ট্রের জন্য যারা দখলদার এবং মানবতা লঙ্ঘন ও গণহত্যার প্রতীক।
প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে আমেরিকা যুদ্ধবাজে পরিণত হলো? এক সময় যাকে বলা হতো স্বাধীনতার প্রতীক, সেই আমেরিকা আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। ভিয়েতনাম, ইরাক, সিরিয়া, ইউক্রেন যেখানে যুদ্ধ, সেখানে মার্কিন অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানির লাভ। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেট বিশ্বের অন্য ১০টি দেশের সম্মিলিত বাজেটের চেয়েও বেশি। এটি কী সত্যি আত্মরক্ষায়, না মুনাফা রক্ষার জন্য? তাই এ ব্যবস্থায় শান্তি হলো হুমকি, যুদ্ধ একমাত্র লাভজনক বিনিয়োগ।
সমাধান কী? সমাধান আছে তবে তার জন্য দরকার জনসচেতনতা, নৈতিক অবস্থান ও রাজনৈতিক চাপ। এ গোষ্ঠীকে উন্মোচন করতে হবে মানুষকে জানতে হবে কারা যুদ্ধ থেকে লাভবান হচ্ছেন। কীভাবে একটি দেশে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিশ্বের সব ধর্মের মানুষকে সচেতন করতে হবে, বিশেষ করে মুসলিম দেশের জনগোষ্ঠীকে ‘কাফির মুশরিকের ষড়যন্ত্র’ বলে উত্তেজিত করে হঠকারী সন্ত্রসী কর্মকাণ্ডে নিরুৎসাহিত করতে হবে। কেননা, এ সবের অজুহাতে যুদ্ধবাজেরা যুদ্ধ শুরু করতে রসদ পায়। কিভাবে জ্ঞানবিজ্ঞানে ও প্রযুক্তিতে উন্নতি করা যায় এবং নিজেদের দেশ নিরাপদ রাখার সামরিক শক্তি অর্জন করা যায়, সে দিকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। রাজনীতিবিদদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে যুদ্ধ লবিস্টদের কাছ থেকে অর্থ নেয়া রাজনীতিবিদদের প্রত্যাখ্যান করতে হবে। স্বাধীন সাংবাদিকতা ও শান্তির প্রচার বাড়াতে হবে মূলধারার মিডিয়ার বাইরেও সত্য প্রকাশের মাধ্যম গড়ে তুলতে হবে।
রাজনৈতিক ও আর্থিক বিনিয়োগকে শান্তির দিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ ও কূটনৈতিক উদ্যোগে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক সংহতি গড়ে তুলতে হবে। যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের ঐক্য রচনা করতে হবে।
আজ প্রশ্ন হওয়া উচিত কে জিতবে বা জিতল সেটি নয়; বরং এ যুদ্ধে কারা সবচেয়ে বেশি লাভ করবে বা করল? যতদিন না আমরা এ প্রশ্ন করবো, ততদিন যুদ্ধ চলবে ন্যায়ের জন্য নয়, মুনাফার জন্য।
লেখক: মহিউদ্দিন