জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো মূলত একমত হলেও, সময়সূচি ও পদ্ধতিগত ইস্যুতে এখনও জটিলতা রয়ে গেছে। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সর্বশেষ রবিবারের বৈঠকে দলগুলো সনদ বাস্তবায়নে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে নীতিগত ঐকমত্যে পৌঁছালেও, তিনটি প্রশ্নে মতপার্থক্য রয়ে গেছে—
গণভোট কখন হবে (সংসদ নির্বাচনের দিনেই নাকি তার আগে), সংসদের উভয় কক্ষে নাকি শুধু উচ্চকক্ষে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সংবিধান আদেশ জারি করা প্রয়োজন কিনা—এই তিন ইস্যুতেই এখন আলোচনা আটকে আছে।
বিএনপি ও তাদের মিত্র দল-জোটগুলো, পাশাপাশি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের দিনেই পৃথক ব্যালটে গণভোট আয়োজনের পক্ষে। সময়সূচি নিয়ে বিএনপির সঙ্গে একমত থাকলেও এনসিপি চায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই সংবিধান আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা হোক। দলটি আরও প্রস্তাব দিয়েছে, ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ যেন একযোগে নিয়মিত সংসদ ও গণপরিষদ হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী সংসদ নির্বাচনের আগে—নভেম্বর বা ডিসেম্বরের মধ্যে—গণভোট আয়োজনের পক্ষে।
সংবিধান-সম্পর্কিত এই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর অনড় অবস্থানের মধ্যেই আজ (বুধবার) দুপুর দুইটায় ‘চূড়ান্ত পর্বে’ আবারও বৈঠকে বসছে ঐকমত্য কমিশন। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ১০ অক্টোবরের মধ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা চূড়ান্ত করে সরকারকে সুপারিশ দিতে চায় তারা। লক্ষ্য, ১৫ অক্টোবরের মধ্যে সব দলের স্বাক্ষরসহ সনদের পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রকাশ করা। ঐদিনই কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা।
যদি রাজনৈতিক দলগুলো শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারে, তবে কমিশন সরকারকে সুপারিশ জমা দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করবে। সম্ভাব্য প্রস্তাবে বলা হবে—সংসদ নির্বাচনের দিনেই পৃথক ব্যালটে গণভোট আয়োজন এবং সংসদের কেবল উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন। তবে পিআর ব্যবস্থা নিয়েও রয়েছে মতবিরোধ। কমিশন আগে প্রস্তাব দিয়েছিল, ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন হবে; কিন্তু বিএনপি এর বিরোধিতা করে বলেছে, নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন নির্ধারণ করা উচিত।
আজকের বৈঠকের আগে মঙ্গলবার রাতে ঐকমত্য কমিশন আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ভার্চুয়াল সভা করে। এতে অংশ নেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শরিফ ভূইয়া, ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক। কমিশনের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। জাতীয় ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও আলোচনায় ছিলেন।
সভা শেষে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি কাঠামো ও প্রস্তাবিত গণভোটের প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা হয়েছে। আজ সকালে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আরেক দফা আলোচনা শেষে বিকেলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসবে কমিশন।
রবিবারের বৈঠক শেষে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, সনদ বাস্তবায়নে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের আওতায় সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়া প্রয়োজন কিনা—এ বিষয়ে বিভিন্ন দল মত দিয়েছে। অধিকাংশ দলই মনে করে, এ ক্ষেত্রে ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আদালতের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা প্রস্তাব দিয়েছি সংসদ নির্বাচনের দিনেই আরেকটি ব্যালটে জুলাই সনদ বিষয়ে গণভোট নেওয়ার। এতে সংবিধান সংশোধনের দরকার নেই।”
তিনি আরও বলেন, “জুলাই সনদে কে কোন ধারায় আপত্তি দিয়েছে, তা জনগণের জানার সুযোগ থাকবে। সনদ স্বাক্ষরিত ও প্রকাশিত হবে, ওয়েবসাইটে থাকবে, রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারেও থাকবে—জনগণ তাদের ম্যান্ডেট অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দেবে।”
অন্যদিকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি তৈরিতে গণভোটের বিষয়ে সবাই একমত। তবে আমরা চাই, এটি নির্বাচনের আগেই নভেম্বর বা ডিসেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হোক, যাতে জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়া এতে ব্যাহত না হয়।”