কিছুদিনের রাজনৈতিক পরিক্রমা বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট, বাংলাদেশে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর কঠোর সমালোচনা, নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্য এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে বিতর্কের ফলে এই চাপ আরো তীব্র হয়েছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চাপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারের প্রশাসনিক হৃৎপিণ্ড সচিবালয়ের অস্থিরতা।
এই চাপ বাড়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল দাবি করার পরও নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। ডক্টর ইউনূসের সরকার এখনো পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করেনি, যা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। বিএনপি ও অন্য দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে, কিন্তু সরকার এখনো পর্যন্ত সুস্পষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করেনি। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন (বিএনপি), রোজার আগে নির্বাচন (জামায়াতে ইসলামী), সংস্কার-বিচার ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে জাতীয় নির্বাচন নয় (এনসিপি) ও জুন ২০২৬-এর মধ্যে নির্বাচন (সরকার)Ñএই চার অবস্থানে কয়েক মাস ধরেই অনড় চারটি পক্ষ। কারো কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আভাস মিলছে না এখনো। চার পক্ষের এই অপরিবর্তনীয় অবস্থান একে অন্যের সঙ্গে যে দূরত্ব বাড়াচ্ছে, তাও ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাওয়ার আওয়াজে সুর মিলিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও বলেছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হওয়া উচিত। সেনাপ্রধানের এই মন্তব্য ডক্টর ইউনূসের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। মিস্টার ওয়াকারের মন্তব্য নিয়ে কোনো কোনো পক্ষ সমালোচনা করলেও যারা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাচ্ছেন, তাদের বাড়তি শক্তি জুগিয়েছে এ বক্তব্য। তারা বলতে শুরু করেছেন, দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচন চায়, জনগণ নির্বাচন চান, ব্যবসায়ীরা নির্বাচন চান, শুধু নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকার নির্বাচন চায় না।
ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার নির্বাচন দিতে অনীহা প্রকাশের কারণে বিএনপি এবং অন্য দলগুলো অভিযোগ করছে, সরকার নির্বাচনের বিষয়টি উপেক্ষা করে অন্যান্য ইস্যুতে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। যেমন চট্টগ্রাম বন্দর বেসরকারিকরণ এবং রাখাইনে ত্রাণ সহায়তার জন্য মানবিক করিডোর স্থাপন। এ ছাড়া এনসিপির প্রতি সরকারের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও উঠেছে। যেখানে বিএনপির মতো দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ চেয়েও এক সপ্তাহে পায় না, সেখানে নিবন্ধনহীন রাজনৈতিক দল এনসিপির নেতা যখন-তখন প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ কীভাবে পান, সে প্রশ্নও তুলেছে কেউ কেউ।
শেষ পর্যন্ত উত্তপ্ত পরিস্থিতির আঁচ কমাতে প্রধান উপদেষ্টা বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন। যদিও এই আলোচনার আগেই সরকারে এনসিপির প্রতিনিধি হিসেবে জায়গা পাওয়া তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়েছে বিএনপি এবং এনসিপিও বিএনপির ঘনিষ্ঠ আখ্যা দিয়ে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগের পাল্টা দাবি তুলেছে।
বিএনপি সরকারের নিরপেক্ষতা রক্ষার স্বার্থে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানÑএই তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে। বিএনপির অভিযোগ, এই উপদেষ্টারা সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ করেছেন এবং তাদের পদত্যাগ সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য জরুরি।
এর পাল্টা দাবি হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) বিএনপির ঘনিষ্ঠ হিসেবে আখ্যায়িত করে ডক্টর ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, ডক্টর সালেহউদ্দিন আহমেদ ও ডক্টর আসিফ নজরুলের পদত্যাগ দাবি করে।
এনসিপির পক্ষ থেকে তিন উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবির ভাষা অনেকের কাছেই অভব্য মনে হতে পারে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, এমন অভিযোগ করে এনসিপির মুখ্য সংগঠক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, আসিফ নজরুল জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে টালবাহানা করছেন। জনগণের রক্তের সঙ্গে তিনি বেঈমানি করছেন। ডক্টর আসিফ নজরুলকে হুমকি দিয়ে এনসিপির এই নেতা বলেন, ঘোষণাপত্র না দিলে আপনি দেশে থাকতে পারবেন না।
গত দেড় দশক ফ্যাসিবাদের দুঃশাসন, গুম-খুন ও ভোটের অধিকার প্রশ্নে ডক্টর আসিফ নজরুল যে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন, তা সবারই জানা। এমন একজনকে নিয়েও এনসিপি নেতার অভব্য উচ্চারণে অনেকেই হতবাক হয়েছেন।
এসব বহুমুখী চাপের মধ্যে ডক্টর ইউনূস পদত্যাগের চিন্তা করছেন বলে চাউর হয়ে যায়। ভার্চুয়াল মিডিয়া ও সংবাদমাধ্যমে আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ডক্টর ইউনূসের পদত্যাগের বিষয়টি। যদিও বিএনপি তার এ পদত্যাগের চিন্তাকে খুব গুরুত্ব না দিয়ে জানিয়ে দেয়, বিএনপি ডক্টর ইউনূসের পদত্যাগ চায় না। তবে তিনি যদি আবেগের বশবর্তী হয়ে পদত্যাগ করেন, সে ক্ষেত্রে জনগণ তার নেতৃত্ব খুঁজে নেবে।
খুশির কথা হলো, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস তার পদত্যাগের চিন্তা থেকে সরে এসেছেন বলে তার প্রেস উইং থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির চার সদস্য প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলোচনা করেও যে খুব আশ্বস্ত হয়েছেন এবং ডক্টর ইউনূসকে আস্থায় নিয়েছেন, তেমনটা আপাতত মনে হচ্ছে না। বিএনপির শীর্ষ চার নেতা প্রথম হোঁচট খান, যখন তারা গিয়ে দেখতে পান তাদের তরফ থেকে পদত্যাগ চাওয়া একজন উপদেষ্টাকে সে আলোচনায় উপস্থিত রেখেছেন প্রধান উপদেষ্টা। নির্বাচনের ব্যাপারেও বিএনপি কোনো আশ্বাস নিয়ে ফিরতে পারেনি প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের যে বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাকেও এক ধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকি হিসেবে মনে হতে পারে কারো কাছে। বৈঠকে বলা হয়, সরকারের ওপর অর্পিত দায়িত্বগুলো পালনে বিভিন্ন সময় অযৌক্তিক দাবি-দাওয়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য এবং কর্মসূচির মাধ্যমে স্বাভাবিক কাজের পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে, যা জনমনে সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করছে। যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন অসম্ভব হয়ে পড়ে, তবে সরকার সব কারণ জনসমক্ষে উত্থাপন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। দেশকে স্থিতিশীল রাখতে, নির্বাচন, বিচার ও সংস্কারকাজ এগিয়ে নিতে এবং চিরতরে স্বৈরাচারের আগমন প্রতিহত করতে বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন বলে মনে করে উপদেষ্টা পরিষদ।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের বক্তব্যে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনপ্রত্যাশীদের জন্য এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে দূরত্ব আরো উসকে দেওয়া হলো কি নাÑসে প্রশ্ন ওঠাও অস্বাভাবিক নয়।
ডক্টর ইউনূস কমফোর্ট ফিল না করলে নির্বাচন দেবেন না, এমন কথাও তিনি কোনো কোনো নেতার কাছে বলেছেন মর্মে খবরেও উৎকণ্ঠিত বিএনপি।
তাই এ কথা সহজেই অনুমান করা যায়, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আদায়ে বিএনপি ক্রমাগত চাপ বাড়াতে থাকবে সরকারের ওপর। এমন কী অন্তর্বর্তী সরকার যদি বিএনপিকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নির্বাচন বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো পদক্ষেপ নেয়, তাহলে গত দেড় দশকে এ বিষয়ে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস কী ভূমিকা রেখেছেন, সে প্রশ্নটিও সামনে চলে আসতে পারে। ইতোমধ্যেই বিএনপির কেউ কেউ ঘরোয়া আলোচনায় এ প্রশ্ন তুলেছেন যে, গত দেড় দশকে ভোটের অধিকার, গুম-খুনসহ মানবাধিকার ও টাকা পাচার নিয়ে ডক্টর ইউনূস শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ সরকারের বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্ন তুলেছেন কি না? ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস তার ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষা ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার বাইরে দেশের বৃহত্তর গণতান্ত্রিক স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে কখনো সোচ্চার হয়েছেন কি না? তাহলে ১৮ বছর বাংলাদেশের গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার ও সুশাসনের জন্য গুম-খুন-হত্যা-হামলা-মামলার শিকার রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের দরদ বেশি হয় কী করে?
সরকারের সঙ্গে নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর এই দ্বন্দ্বের রেশ অব্যাহত থাকা অবস্থায় তারা আরো কয়েকটি ফ্রন্ট খুলে বসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করাকে কেন্দ্র করে চলছে রাজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন। একই সঙ্গে সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ নিয়ে আন্দোলনে অচল হয়ে পড়েছে সরকারের প্রশাসনিক হৃৎপিণ্ড সচিবালয়। কয়েক দিন ধরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র-সংক্রান্ত আন্দোলনে অবরুদ্ধ নগর ভবন। অচল হয়ে আছে আন্দোলনে উত্তপ্ত সচিবালয়ও। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, অরাজনৈতিক অসামরিক একটি অন্তর্বর্তী সরকার কি তার সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভুল করছে?
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক