ইবরাহিম (আ.) দোয়া করলেন, ‘হে প্রভু! আমাকে একটি নেককার সন্তান দান করুন। ফলে আমি তাকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।’ (সুরা সাফফাত : ১০০) আল্লাহর বন্ধু ইবরাহিম (আ.) ছিলেন নিঃসন্তান। জীবনের পড়ন্তবেলায় আল্লাহতায়ালা তাকে সন্তান দান করেন। জন্মের পর নাম রাখেন ইসমাইল। আরবি ‘ইসমা’ অর্থ শোন আর হিব্রু ভাষায় ‘ইল’ মানে আল্লাহ। সন্তানের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা ইবরাহিম (আ.)-এর প্রার্থনা কবুল করেছেন বিধায় এই নাম রাখা হয়েছে।
পরীক্ষার জীবন
জন্মের পরপরই কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন ইসমাইল (আ.)। মহান আল্লাহর নির্দেশে তিনি স্ত্রী হাজেরা ও শিশু ইসমাইলকে বর্তমান কাবাগৃহের সন্নিকটে ফারান পাহাড়ের পাদদেশে রেখে যান। জনমানবহীন মরুভূমিতে মা হাজেরা ও শিশু ইসমাইল একাকী জীবনযাপন করতে লাগলেন। একদিন নিদারুণ পিপাসায় কাতর হয়ে মা হাজেরা (আ.) পানির খোঁজে সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ে দৌড়াতে থাকেন। কিন্তু তিনি পানির চিহ্নমাত্র দেখতে পেলেন না। অবশেষে নিরাশ হয়ে ফিরে এসে দেখেন ইসমাইলের পায়ের কাছে একটি পানির ফোয়ারা উতলে উঠছে। বর্তমানে এটিই ঝমঝম কূপ নামে পরিচিত।
ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা
ইসমাইল (আ.)-এর বয়স যখন ৭ কিংবা ১৩ বছর, তখন বাবা ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নযোগে তাকে কোরবানি করার নির্দেশ পান। পবিত্র কোরবানে এ ঘটনা এভাবে বর্ণিত হয়েছেÑ‘অতঃপর যখন পুত্র পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহিম বলল, বৎস! আমি স্বপ্নে তোমাকে জবাই করতে দেখেছি।’ (সুরা সাফ্ফাত : ১০২)
পয়গম্বরদের স্বপ্ন ওহি হয়ে থাকে। তাই এ স্বপ্নের অর্থ ছিল, ইসমাইলকে জবাই করার ব্যাপারে ইবরাহিমের প্রতি আল্লাহপাকের নির্দেশ। এ নির্দেশ তিনি সরাসরি ফেরেশতার মাধ্যমেও দিতে পারতেন, কিন্তু স্বপ্নে দেখানোর তাৎপর্য হলো, ইবরাহিম (আ.)-এর আনুগত্য পূর্ণমাত্রায় প্রকাশ পাওয়া। স্বপ্নের মাধ্যমে প্রদত্ত নির্দেশের ভিন্ন অর্থ নেওয়ার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। কিন্তু আল্লাহর বন্ধু ইবরাহিম (আ.) কোনোরূপ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আশ্রয় নেওয়ার পরিবর্তে নিঃসংকোচে আল্লাহপাকের নির্দেশের সামনে মাথানত করে দেন। তিনি আল্লাহকে প্রশ্ন করেননি, ‘হে প্রভু! এত কঠিন নির্দেশ কেন আমাকে দিলে? পৃথিবীর কোনো আইনে তো পিতার কর্তৃক সন্তান জবাই করার নজির নেই। কোনো সুস্থ বিবেকও এটা সমর্থন করে না। তাহলে কেন এই নির্দেশ?’
কী এর রহস্য? ইবরাহিম (আ.) সব দ্বিধাসংকোচ পরিহার করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আল্লাহর নির্দেশ পালনে তৈরি হয়ে গেলেন। তবে মহান মালিকের নির্দেশের গুরুত্ব সন্তান কতটা উপলব্ধি করতে শিখেছে, তা যাচাইয়ের জন্য ছেলেকে ডেকে বললেন, ‘হে বৎস! আমি স্বপ্নে তোমাকে জবাই করতে দেখেছি। এতে তোমার কী অভিমত?’
ইসমাইল আল্লাহর বন্ধুর পুত্র এবং ভাবী পয়গম্বর। তা ছাড়া তার ঔরসেই একদা জন্মগ্রহণ করবেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মদ (সা.) । তাই তিনি পিতাকে জিজ্ঞেস করেননি, ‘আব্বু! আমি এমন কী অপরাধ করেছি যে, আমাকে জবাই করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই কঠিন নির্দেশের মধ্যে আল্লাহর কী রহস্য?’ বরং তিনি সরলকণ্ঠে বললেন, ‘আব্বাজান! আপনাকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা পালন করুন। আমাকে ইনশাআল্লাহ ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।’ (সুরা সাফ্ফাত : ১০২)
ভবিষ্যতের কোনো কথা বলতে গিয়ে ‘ইনশাআল্লাহ’ বলা আল্লাহর খেশানো আদব, যা পবিত্র কোরআনে আমাদের নবীজির এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বর্ণিত হয়েছে। শিশু ইসমাইলের কথায় আদব ও বিনয় প্রকাশ পেয়েছে। কারণ তিনি ‘ইনশাআল্লাহ’ বলে ব্যাপারটি আল্লাহর কাছে সমর্পণ করেছেন। আবার ‘আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন’ বলে বুঝিয়েছেন, ধৈর্য ও সহনশীলতা শুধু আমার একার কৃতিত্ব নয়; বরং জগতে আরো বহু ধৈর্যশীল ব্যক্তি রয়েছেন। (তাফসিরে রুহুল মায়ানি)
মিনা প্রান্তরে ইসমাইল
মা হাজেরা (আ.) তার কলিজার টুকরো, হৃদয়ের মানিক আদরের দুলাল ইসমাইলকে গোসল করিয়ে, উত্তম পোশাক পরিয়ে, প্রাণভরে চুমু খেয়ে, চিরজনমের মতো বুকে জড়িয়ে আদর-সোহাগে আপ্লুত করে বললেন, ‘যাও আমার প্রাণ, আল্লাহর জন্য নিজেকে উৎসর্গ করো।’ পুত্রকে কোরবানির জন্য মিনার উদ্দেশে রওনা করেন ইবরাহিম (আ.)। পথে কয়েকবার শয়তান ইবরাহিম (আ.)-এর গতিরোধ করে আল্লাহর নির্দেশ পালনে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু তিনি পাথর মেরে শয়তানকে তাড়িয়ে দেন। আজ পর্যন্ত এই প্রশংসনীয় কাজের স্মৃতিমন্থন করে হাজিরা মিনায় তিনটি স্থানে পাথর নিক্ষেপ করেন। এটি হজের গুরুত্বপূর্ণ আমলও বটে।
কোনো কোনো বর্ণনায় রয়েছে, রাস্তায় ইসমাইলের সঙ্গে শয়তানের তর্ক হয়। তিনি শয়তানকে অভিশম্পাত করেন এবং আল্লাহর জন্য কোরবানি থেকে নিজেকে উৎসর্গিত করেন। মিনায় পৌঁছে ইবরাহিম (আ.) যখন জবাই করতে পুরোপুরি প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন, তখন ইসমাইল (আ.) বাবাকে বলে দিলেন, ‘আপনি আমাকে উপুড় করে শুইয়ে দিন এবং আপনার চোখ দুটো বেঁধে নিন। যাতে আমার মুখমণ্ডল দেখে আপনার অন্তরে পিতৃস্নেহ উতলে না ওঠে। আর আমিও ছুরি দেখে ঘাবড়ে না যাই। পিতা-পুত্রের এই আচরণ আল্লাহপাক এতটাই পছন্দ করেছেন, পবিত্র কোরআনে তা উল্লেখ করে চিরদিনের জন্য সংরক্ষিত করেছেন।’
এরশাদ হয়েছেÑ‘যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহিম তাকে জবাই করার জন্য মাটিতে উপুড় করে শুইয়ে দিল। তখন আমি ডেকে বললাম, হে ইবরাহিম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে জবাই করার জন্য দিলাম এক মহান জন্তু।’ (সুরা সাফ্ফাত : ১০৩-১০৭)
ইন্তেকাল
ইসমাইল (আ.) ১৩৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাওরাতের এক বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ফিলিস্তিনে ইন্তেকাল করেন এবং সেখানে সমাহিত হন। কিন্তু আরব ঐতিহাসিকরা বলেন, তিনি বায়তুল্লাহ শরিফের পাশে সমাহিত হয়েছেন।