আওয়ামী সন্ত্রাসীদের নাশকতার প্রশিক্ষণ দেওয়া মেজর সাদেকুল হক সাদেকের বিষয়ে আরো গুরুতর তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগের অনুসারী হিসেবে বিয়ে করেন একই আদর্শের মেয়েকে। তার শ্বশুড়বাড়ির লোকজন কট্টর আওয়ামীপন্থি। শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গেও তাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাই সরকার হটাতে স্বামী-স্ত্রী মিলেই চালাচ্ছিলেন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য সাদেক ও তার সহধর্মিণী সুমাইয়া জাফরিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় পুলিশ।
নাশকতার লক্ষ্যে রাজধানীর ভাটারা থানার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার পাশে কে বি কনভেনশন সেন্টারে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র ও অনলাইন যুদ্ধের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন মেজর সাদেক ও সুমাইয়া। তারা প্রায় পাঁচ মাস ধরে আওয়ামী ক্যাডারদের সংগঠিত করছিলেন। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কয়েকজন সাবেক নেতাকে নিয়ে কীভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছিল, সে বিষয়ে বেরিয়ে আসছে একের পর এক তথ্য। ভাটারা থানার মামলার তদন্তের স্বার্থে তাদের দুজনকে হেফাজতে নেওয়া দরকার বলে মনে করছে পুলিশ। ইতোমধ্যে সেনা হেফাজতে থাকা মেজর সাদেককে নিজেদের হেফাজতে পেতে যথাযথ মাধ্যমে চিঠিও পাঠিয়েছে তারা। এ বিষয়ে সর্বশেষ গতকাল রোববার পর্যন্ত চিঠির জবাব পায়নি কিংবা মেজর সাদেককে নিজেদের হেফাজতে পায়নি বলে জানিয়েছে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র।
সামরিক বিশ্লেষক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) হেলাল উদ্দিন বলেন, মামলা যেহেতু বেসামরিক এলাকায় এবং পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করছে। নাশকতার লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের বিষয়ে মেজরের সংশ্লিষ্টতা এখন প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত। তাই সশস্ত্র বাহিনী থেকে মেজর সাদেককে চাকরিচ্যুত করে তদন্তকারী সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা যেতে পারে।
প্রশিক্ষণের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এ পর্যন্ত ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে তদন্ত সংস্থা ডিবি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান আমার দেশকে জানান, রাজধানীর বাইরে থেকে স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় আরো চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে ২২ জনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছিল পুলিশ।
জানা গেছে, কট্টর আওয়ামীপন্থি অফিসার হিসেবে পরিচিত মেজর সাদেক ও তার স্ত্রী সুমাইয়া ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের শাসনামলে গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা করতেন। তার শ্বশুর কুমিল্লার সাবেক জিওসি মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর হারুন ছিলেন হাসিনার অত্যন্ত অনুগত। জেনারেল জাহাঙ্গীর চাকরিরত অবস্থায় হাসিনার পা ছুঁয়ে সালাম করার ভিডিও ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। জিওসি থাকা অবস্থায় জেনারেল জাহাঙ্গীরের এডিসি ছিলেন মেজর সাদেক। পরে নিজের মেয়ে সুমাইয়াকে বিয়ে দেন সাদেকের সঙ্গে। হাসিনার আস্থাভাজন অফিসার হিসেবে নিজের আখের গুছিয়েছেন জাহাঙ্গীর। তার দহরম-মহরম সম্পর্ক ছিল হাসিনার পলাতক সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকের সঙ্গেও।
সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপকালে বলেন, এডিসিরা সাধারণত একান্ত সহকারী হিসেবে কাজ করেন। খুবই বিশ্বস্ত অফিসারদের এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ঘুমানো এবং বাথরুমে যাওয়া ছাড়া সবখানে, সব সময় পাশে থাকেন এডিসি।
জানা গেছে, মেজর সাদেক ৭৪ বিএমএ লং কোর্সের মাধ্যমে ২০১৬ লেফটেন্যান্ট পদে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি পান ২০১৯ সালের ১ জুন। ২০২৩ সালের ২২ জুন মেজর পদে পদোন্নতি পান। সেনাকুঞ্জ কনভেনশন সেন্টারে বিবাহ করেন একই বছরের ৬ মে। তিনি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ও রামু ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন বলে জানা গেছে।
কয়েকটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মেজর সাদেকের আদি বাড়ি জামালপুরে। তবে তারা দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় থাকেন না। সম্ভবত ঢাকায় সেটেল। তবে তার পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত। তার নানার বাড়ি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চরখাগড়া গ্রামে। তার মামা এনায়েত সরকার খাগড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সুমাইয়া ছাত্রলীগ করতেন। তার গ্রামের বাড়ি যশোরের শার্শায়। তার বাবা মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর বাংলাদেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে পরিচিত কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের জিওসি ছিলেন। সুমাইয়ার চাচা একেএম ফজলুল হক শার্শা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তাদের পুরো পরিবারই কট্টর আওয়ামীপন্থি হিসেবে পরিচিত।
জানা গেছে, উচ্চাভিলাসী মেজর সাদেক চাকরির শুরু থেকেই শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন। জাহাঙ্গীরের মেয়েকে বিয়ে করে পেয়ে যান সেই সুযোগ। তার সামরিক ও হাসিনার অনুগত শ্বশুর এবং চাচাশ্বশুরের আওয়ামী পদের আশীর্বাদে হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও বোন শেখ রেহানার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে মেজর সাদেক ও তার স্ত্রী সুমাইয়ার। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরও জয়ের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত থাকে মেজর সাদেক ও তার স্ত্রীর।
আওয়ামী ক্যাডারদের যেভাবে সংগঠিত করেন এ দম্পতি
কয়েকটি সূত্র জানায়, মেজর সাদেক ও তার স্ত্রী সুমাইয়া গত মার্চ থেকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংগঠিত করছিলেন। একপর্যায়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক অন্যতম শীর্ষ নেতা শরীফ হাসান অনু, বরগুনার আওয়ামী লীগ নেতা সোহেল রানা, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইয়ামিন ও মোহনসহ কয়েকজন তার বাসায় গেলে তিনি ঘণ্টাখানেক তাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেন।
মেজর সাদেক তাদের বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান। সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। দুই-তিন মাস হোক আর পাঁচ-দশ বছর হোক, বাংলাদেশে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ- এ দুই দলই থাকবে। আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে হবে। অস্ত্র, টাকা-পয়সা লাগলে আমি ব্যবস্থা করব। নেত্রী (শেখ হাসিনা) আসার ঘোষণা দিলে এয়ারপোর্টে দুই থেকে তিন লাখ লোক নিয়ে আমাদের অবস্থান করতে হবে। বাধা এলে প্রতিহত করতে হবে।’
এরপর তারা নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। মেজরের স্ত্রী সুমাইয়ার তত্ত্বাবধানে সিগন্যাল অ্যাপ ব্যবহার করে একটি গ্রুপ খোলা হয়, যেখানে আওয়ামী ক্যাডারদের যুক্ত করা হয় এবং তাদের একটি করে ইউনিক কোড নম্বর দেওয়া হয়। সিগন্যাল অ্যাপে গ্রুপটির নাম ওডিবি। সদস্য সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। সোহেল রানার কোড নম্বর ছিল ৩৪। কারো নাম উল্লেখ না করে সিগনাল অ্যাপের সদস্যদের মধ্যে কোড নম্বরের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়।
জানা যাচ্ছে, পরিচয় হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময় সোহেল (ভাটারা থানার মামলায় গ্রেপ্তার) বিভিন্ন সময় ২০-২৫ জনকে মেজরের স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। তাদেরও কোড নম্বর দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলো- মেহেরপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাজ্জাদুর রহমান, নরসিংদীর বেলাবোর ইমরান, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শরীয়তপুরের রাশেদ, ছাত্রলীগ নেতা শ্যামল এবং আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক হোসেন। ক্রমান্বয়ে সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকায় গত জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে সোহেলকে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ফোন করে মিটিং করার মতো একটি জায়গার ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলেন সুমাইয়া।
সোহেল তখন শামীমা নাসরিন শম্পাকে (ভাটারা থানার মামলায় গ্রেপ্তার) মিটিং করার জন্য একটি বড় রুম অথবা হলরুমের ব্যবস্থা করে দিতে বলেন। ব্যবসায়িক ও নিজ এলাকার পরিচয়ের সূত্র ধরে গোপালগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা বায়েজিদের শরণাপন্ন হন শম্পা। তিনি আওয়ামী লীগের গোপন মিটিংয়ের বিষয়ে বায়েজিদকে অনুরোধ করে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার পাশের কে বি কনভেনশন সেন্টারের দ্বিতীয় তলার হল ভাড়া করার ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বায়েজিদ তাদের গ্রুপের এক সদস্য রিপনের মালিকানাধীন আরএসএফ ট্রাভেল এজেন্সির একটি সেমিনারের নাম করে কে বি কনভেনশন সেন্টারের হল ভাড়া করে দেন। গত ৮ জুলাই ওই কনভেনশন সেন্টারে দুই দফায় (প্রথম দফায় প্রায় ২০০ জন এবং পরের দফায় প্রায় ২৫০ নেতাকর্মী অংশগ্রহণ করে) ৪৫০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দিনভর সেখানে নাশকতার ট্রেনিং দেওয়া হয়। মেজর সাদেক ও সুমাইয়া সারা দিন সেখানে উপস্থিত থেকে প্রশিক্ষণ দেন। এর মধ্যে অনলাইনে গুজব ছড়ানো, নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ, তথ্য আদান-প্রদান এবং সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ করা- সর্বোপরি সশস্ত্র ট্রেনিংয়ের বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা দেওয়া হয়।
আরো জানা গেছে, শম্পা ও সোহেল টেক্সটাইল পণ্যের স্টক লটের ব্রোকার হিসেবে আগে থেকে পরিচিত। উভয়ে থাকেন উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে। সোহেলের বাড়ি বরগুনার তালতলী উপজেলার ২ নম্বর ছোট বগী এলাকায়। তার বাবা আবদুস সোবহান গোলন্দাজ এক সময় ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। ২০২০ সালে তিনি মারা যান। শম্পার স্বামী আহাদুজ্জামান অবসরপ্রাপ্ত হেলথ ইন্সপেক্টর। স্বামীর বাড়ির সূত্রে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ভরাসুর গ্রামে বাড়ি শম্পার।
মেজর সাদেকের সঙ্গে তার সম্পর্ক তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে গ্রেপ্তার সোহেল জানান, হোয়াটসঅ্যাপে আওয়ামী লীগ সমর্থিত বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার সূত্র ধরে গত মার্চে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইয়ামিন তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ইয়ামিন থাকেন উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরে। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। ফোনের মাধ্যমে ইয়ামিন তাকে (সোহেল) আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করতে উৎসাহিত করেন। একপর্যায়ে তাদের সাক্ষাৎ হয় উত্তরার জসীমউদ্দীন এলাকায়।
সম্পর্কের সূত্র ধরে সোহেলকে উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের প্রিয়াংকা সোসাইটিতে সাদেকের বাসায় নিয়ে যান ইয়ামিন। সেখানে আরো কয়েকজন ছিল। এর মধ্যে দুজনের নাম শরীফ হাসান অনু ও মোহন। শরীফ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক অন্যতম শীর্ষ নেতা।
শম্পা ও সোহেলের কাছে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মেজর সাদেক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে বৈঠক করে প্রশিক্ষণ দেন। ঢাকার আরো চারটি স্থানে এ ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন তারা। কাঁটাবন মোড়ের পাশে মসজিদের বিপরীতে একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টের তৃতীয় তলায় গত জুন মাসে ৭০-৮০ জনকে নিয়ে একটি বৈঠক হয়। মিরপুরের ডিওএইচএস এলাকায় ১০ নম্বর রোডের একটি বাসার বেজমেন্টে আরেকটি বৈঠক হয়। গত জুলাই মাসের প্রথম দিকে পূর্বাচলের ‘সি-শেল’ রিসোর্টে আরেকটি বৈঠক হয়। এছাড়া সুরক্ষিত একটি স্থানেও গোপন বৈঠক হয়।