ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি) বাংলাদেশের প্রকৌশল পেশাজীবীদের জাতীয় পেশাজীবী সংগঠন, এটি সোসাইটিস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট ১৮৬০ দ্বারা নিবন্ধিত। সম্প্রতি আইইবি, ঢাকা কেন্দ্র আয়োজিত একটি আলোচনা সভা ঘিরে প্রকৌশলীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এই আলোচনা সভা প্রকৌশল পেশার স্বাতন্ত্র্যকে লঙ্ঘন করে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রচারণা সভায় পরিণত হয়েছে। পেশাজীবীরা বলছেন, এটি প্রকৌশলীদের চাঁদার অর্থের অপব্যবহার এবং পেশাগত মর্যাদার চরম অবমাননা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে আইইবি ঢাকা কেন্দ্র
আইইবি ঢাকা কেন্দ্রের সভাপতি প্রকৌশলী মো. হেলাল উদ্দিন তালুকদারের সভাপতিত্বে রাজনৈতিক বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য প্রকৌশলী আব্দুস সোহবান, এ্যাবের সাবেক মহাসচিব আলমগীর হাসিন আহমেদ, আইইবি সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. সাব্বির মোস্তফা খান প্রমুখ।
দলীয় প্রচারণায় ব্যবহৃত হচ্ছে আইইবির মঞ্চ?
গণ অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে আয়োজিত আলোচনা সভার অতিথি পরিচয়ে এ্যাব ও বিএনপির পরিচয় ছিলো মূখ্য
২ আগস্ট আয়োজিত এই আলোচনা সভায় মূল বক্তাদের তালিকায় প্রথমে বিএনপি ও তাদের পেশাজীবী সংগঠন এ্যাবের নেতাদের নাম উল্লেখ করা হয়। আইইবির বর্তমান প্রেসিডেন্টের নাম তালিকায় ৫ নম্বরে রাখা হয়, যা বর্ষীয়ান প্রকৌশলী আব্দুল জলিলের মতে, আইইবিকে একটি রাজনৈতিক দলের অনুগামী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করার ইঙ্গিত বহন করে।
জুলাই ঐক্য– ভাঙার অপচেষ্টা?
পেশাজীবীদের একটি বড় অংশ মনে করেন, এই সভা গত জুলাইয়ে গড়ে ওঠা সর্বদলীয় প্রকৌশলী ঐক্যকে ভাঙার প্রথম প্রয়াস। জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে প্রোগ্রামে বিএনপির পেশাজীবী সংগঠন এ্যাবের বাইরে স্থান হয়নি কোন অতিথির।
২০১৯ সালে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নির্মমভাবে প্রাণ হারানো বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ ২০২৫ সালে “প্রতিবাদী তারুণ্য” ক্যাটাগরিতে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হলেও, তার আত্মত্যাগ কখনোই আইইবির কোনো আয়োজনে স্বীকৃতি পায়নি। একইভাবে, ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রথম সাহসী কণ্ঠস্বর ড. মাহমুদুর রহমান, যিনি ২০২৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন, তাকেও এই আয়োজনে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
সভার আয়োজনে জুলাই বিল্পবে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, এমনকি জুলাই এ শহীদ ও আহত প্রকৌশলীদের তালিকা এখন পর্যন্ত আইইবি তৈরি করতেক পারেনি। আইইউটি গ্রাজুয়েট মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার শহীদ তানভীনসহ প্রকৌশল সেক্টরের জুলাই শহীদেরা অনুপস্থিত ছিলেন আইইবির আয়োজন থেকে। নামকাওয়াস্তে শহীদ ওয়াসিম, আসহাবুল ইয়ামিনসহ কয়েকজন শহীদের পরিবারকে উপস্থিত করে বাকি দলীয় প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করে আইইবি ঢাকা কেন্দ্র।
আইইবিতে রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, কোন খরচ ছাড়াই?
এই সভা নিয়ে বিতর্কের আগেও গত ২১ জুলাই বিএনপি কর্তৃক আহুত “সম্মিলিত পেশাজীবী সমাবেশ” নজীরবিহীনভাবে আইইবির টেনিস গ্রাউন্ড উপড়িয়ে সংশ্লিষ্ট স্থানে আয়োজন করা হয়। কোনো ধরনের আর্থিক পরিশোধ ছাড়াই গ্রাউন্ড ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় প্রকৌশলীরা প্রশ্ন তুলেছেন- একটি পেশাদার প্রতিষ্ঠান কেন একটি রাজনৈতিক দলের বিনা খরচে প্ল্যাটফর্ম হতে যাবে?
আইইবি টেনিস গ্রাউন্ডে ২১ জুলাই বিএনপি আয়োজিত সম্মিলিত পেশাজীবী সমাবেশে অনলাইনে বক্তব্য রাখছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া
পেশাদার পাঠ্যক্রম বন্ধ, জায়গা দখলে রাজনীতি?
আইইবির একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষামূলক কার্যক্রম AMIE কোর্স বন্ধ করে, এর পরিবর্তে সেই স্থান ব্যবহার করা হচ্ছে জাসাসের দলীয় কার্যালয় হিসেবে। একাধিক সূত্র জানায়, সম্প্রতি AMIE নির্ধারিত স্থানে ‘জাসাস’ এর কার্যালয়ের ব্যানার সেখানে ঝোলানো হয়, যা পরে সমালোচনার মুখে নামিয়ে ফেলা হয়।
আইইবি কর্তৃক AMIE কোর্স পরিচালিত হয়, যা এখন বন্ধ করে স্থানটি দলীয় মিটিংয়ে ব্যবহৃত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে
আর্থিক প্রতিবেদন নেই, স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ
আইইবির অভ্যন্তরীণ আর্থিক স্বচ্ছতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিগত এক বছরে নির্বাহী, সেন্ট্রাল কাউন্সিল বা লোকাল কাউন্সিলে বারংবার জবাবদিহীতা চাওয়ার পরেও বিস্তারিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। প্রকৌশলীদের দেওয়া চাঁদার অর্থ কোথায়, কিভাবে, কী খাতে ব্যয় হচ্ছে- তা জানা না যাওয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতির অভিযোগ উঠেছে।
ক্ষুব্ধ পেশাজীবীরা, সভা বর্জনের ঘোষণা
এইসব ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়ে বিভিন্ন প্রকৌশলীদের সংগঠন এবং সাধারণ প্রকৌশলীরা ২ আগস্টের আলোচনা সভা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। সচেতন প্রকৌশলী সমাজের ব্যানারে সভা বর্জনের ঘোষণা দিয়ে একটি ফটোকার্ড সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে, তাদের দাবি- আইইবি যেন কোন দলের প্রচারণার মাধ্যম না হয়, বরং আইইবি প্রকৌশল পেশার উন্নয়ন, ন্যায্য দাবি আদায় এবং পেশাদার শিক্ষার প্রসারে কাজ করে। অন্যদিকে আলোচনা সভা দলীয়করণের বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার কামরুল ইসলাম, যিনি অভ্যর্থনা উপকমিটির সভাপতি। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে আইইবি ঢাকা কেন্দ্রের প্রেসিডেন্ট বরাবর একটি চিঠির মাধ্যমে এই আলোচনা সভা বর্জনের সিদ্ধান্ত জানান।
এই প্রতিবেদন প্রস্তুতের সময় যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও আইইবির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।