প্রতিবেদন: অনুসন্ধান ডেস্ক
বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট যুগের শুরু হতে না হতেই, একটি সরকারি গাইডলাইন জন্ম দিচ্ছে নতুন শঙ্কার—সরকার চাইলে যেকোনো সময় বন্ধ করে দিতে পারবে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সংযোগ।
কি বলছে গাইডলাইন?
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ২৫ মার্চ ২০২৫ “Regulatory and Licensing Guidelines for Non-Geostationary Orbit (NGSO) Satellite Services Operators in Bangladesh” শীর্ষক একটি চূড়ান্ত গাইডলাইন প্রকাশ করেছে যেটা এখানে পাবেন।
এই গাইডলাইনের ৭ নাম্বার পেজের ১৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে:
১। প্রতিটি অপারেটরকে বাংলাদেশের ভেতরে একটি গেটওয়ে স্থাপন করতে হবে।
২। সব ইউজার টার্মিনালকে এই গেটওয়ের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে।
৩। আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ডেটা ট্রাফিক সরকার অনুমোদিত IIG-এর মাধ্যমেই পরিচালিত হবে।

এই তিনটি শর্ত প্রযুক্তিগতভাবে এমন এক কাঠামো তৈরি করে, যার মাধ্যমে সরকার পরোক্ষভাবে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট বন্ধ করার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যায়।
নতুন প্রযুক্তি, পুরনো নিয়ন্ত্রণ?
স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো—সরকারি নিয়ন্ত্রিত অবকাঠামো এড়িয়ে সরাসরি ব্যবহারকারীর কাছে ইন্টারনেট পৌঁছানো। কিন্তু নতুন গাইডলাইনের শর্তে, সেই “ফ্রি এক্সেস” ধারণা প্রায় নিষ্প্রভ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই গাইডলাইন কার্যত একটি ডিজিটাল “Kill Switch”। যেহেতু সব ট্রাফিক যাবে সরকারি নিয়ন্ত্রিত গেটওয়ে ও IIG দিয়ে, সেহেতু চাইলেই সরকার যে কোনো সময় সেবা বন্ধ করে দিতে পারবে।
ড. ইউনুস যা বলেছিলেন… বাস্তবে হচ্ছে ঠিক উল্টো
জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেছিলেন:
“Starlink চালু হলে, ভবিষ্যতে আর কোনো সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করতে পারবে না।”
কিন্তু বাস্তবে যা ঘটেছে, তা সম্পূর্ণ বিপরীত। Starlink-এর মতো সংস্থা সাধারণত inter-satellite link ব্যবহার করে যা সরাসরি ব্যবহারকারীর ডিভাইসে সংযোগ দেয়, কোনো স্থানীয় গেটওয়ে ছাড়াই। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বাধ্যতামূলকভাবে লোকাল গেটওয়ে ব্যবহারের নিয়ম চাপিয়ে দিয়েছে—যার মানে, সরকারের হাতেই থাকছে বন্ধের সুইচ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—এটা জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
সাবেক বেসিস সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলেছেন:
“এই গাইডলাইনের মাধ্যমে সরকার প্রমাণ করেছে, তারা জনগণের তথ্য স্বাধীনতা নয়, বরং নিয়ন্ত্রণ চায়। ইন্টারনেট এখন মৌলিক অধিকার। এটি বন্ধ করার অধিকার কোনো সরকারের থাকা উচিত নয়।”
তিনি আরও বলেন:
“যুব সমাজ জুলাই আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছে। তারা চায় একটি মুক্ত ও স্বাধীন ইন্টারনেট। এই আইন সেই স্বপ্নের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।”
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক
এই গাইডলাইন বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার কমিশন কর্তৃক ঘোষিত ডিজিটাল অধিকার ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেখানে অন্যান্য দেশ স্যাটেলাইট ইন্টারনেটকে উন্মুক্ত রাখছে, সেখানে বাংলাদেশ করছে নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো তৈরি।
সরকার গাইডলাইনে সরাসরি “ইন্টারনেট বন্ধ” বলছে না—কিন্তু গেটওয়ে আর IIG-এর নিয়মের মধ্য দিয়ে সে ক্ষমতা পরোক্ষভাবে নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে।
এটা শুধু প্রযুক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ নয়—এটা জনগণের তথ্য অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর এক ভয়ংকর হস্তক্ষেপ।
আমরা কি তাহলে স্যাটেলাইট যুগে এসেও সরকারের অনুমতির অপেক্ষায় থাকবো, তথ্য জানতে বা বলতে?
আপনার মতামত দিন: [email protected]